ইমারজেন্সি পিল একটি হরমোনজাত ওষুধ, যা জরুরি পরিস্থিতিতে গর্ভধারণ রোধে ব্যবহৃত হয়। এই পিল ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা থাকা জরুরি, যাতে নারীরা সঠিক সময়ে গ্রহণ করতে পারেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়াতে পারেন। তাছাড়া এটি ব্যবহারের সঠিক নিয়ম জানা না থাকলে নানা রকম শারীরিক সমস্যা হতে পারে। অনেকেই ইমারজেন্সি পিলের নাম জানলেও এটি জানেন না যে আসলে এই ইমার্জেন্সি পিল কি বা এটি খাওয়ার নিয়মই বা কি, কখন খেলে কাজ হয় ইত্যাদি।
তাই সকলের বিশেষ করে নারীদের সচেতনতার স্বার্থে আমাদের আজকের এই পোস্ট কারণ এই পোস্টের মাধ্যমেই আমরা আপনাদেরকে ইমারজেন্সি পিলের আদ্যোপান্ত জানানোর চেষ্টা করবো। পোস্টটি শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইলো।
ইমার্জেন্সি পিল কি?
ইমারজেন্সি পিল হচ্ছে এমন এক ধরণের ঔষধ যা অসতর্কতায় যৌন মিলনের গর্ভধারণের ঝুঁকি কমানোর জন্য গ্রহণ করা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে ইমারজেন্সিও পিল হচ্ছে একটি জন্ম নিরোধক বড়ি, ট্যাবলেট, কিংবা ক্যাপসুল। কখনও কখনও এটিকে মর্নিং-আফটার পিলও বলা হয়। ইমার্জেন্সি পিলের প্রধান কাজ হলো গর্ভধারণের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা।
এই পিল সাধারণত যৌন সম্পর্কের পর যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা হয়, তত বেশি কার্যকর হয়। অধিকাংশ পিল ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কাজ করে, তবে কিছু উন্নত পিল ৫ দিন পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে। তবে আপনি যে পিলই ব্যবহার করেন না কেন অবশ্যই তা নিয়ম জেনে ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত বা ঘন ঘন ব্যবহার করলে তা শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে, এবং মাসিকচক্রে অস্বাভাবিকতা আনতে পারে।
ইমার্জেন্সি পিল কিভাবে কাজ করে?
ইমার্জেন্সি পিল হরমোনের মাধ্যমে গর্ভধারণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং এটি শুধু জরুরি অবস্থার জন্যই প্রযোজ্য। এটি শুধুমাত্র গর্ভধারণ প্রতিরোধে কাজ করে, কোন প্রকার গর্ভপাত ঘটায় না। অর্থাৎ কেউ যদি ইতিমধ্যেই গর্ভধারণ করে থাকে তাহলে এই পিল খাওয়ার পরও কাজ করবে না। যৌন সঙ্গমের পর যত দ্রুত ইমারজেন্সি পিল খাবেন তত দ্রুতই এটি কাজ করবে এবং এটি কার্যকর হবার সম্ভাবনা ততই বেশি থাকবে। যাইহোক, এটি কিভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে আমরা আরেকটু বিস্তারিত বলতে চাই; অর্থাৎ এটি খাওয়ার পর গর্ভধারণের প্রক্রিয়াটি কিভাবে ব্যাহত হয় সেটাই আমরা জানাতে চলেছি।
-
ডিম্বাণু নির্গমন প্রতিরোধ
ইমারজেন্সি পিলের সবথেকে বড় কার্যকারিতা হচ্ছে ডিম্বাণু নির্গমন প্রতিরোধ করা। স্বাভাবিকভাবে যৌন সঙ্গমের সময় হরমোন ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গমন হতে থাকে এবং সঙ্গমের পর পর্যন্ত চলতে থাকে। ইমারজেন্সি পিল এই প্রক্রিয়াটিকেই পিছিয়ে দেয় বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। ফলে ডিম্বাণু নির্গত না হওয়ায় শুক্রাণুর সাথে তার মিলনের কোনো সুযোগ থাকে না, ফলে গর্ভধারণ হয় না।
-
নিষেক প্রতিরোধ
যদি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে যায় তাহলে এক্ষেত্রে ইমারজেন্সি পিল এর কাজ হচ্ছে এটি জরায়ুর আবরণকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যেন নিষিক্ত ডিম্বাণুটি কোনোভাবেই জরায়ুতে সংযুক্ত হতে না পারে।
-
শুক্রাণুর গন্তব্যে পৌঁছাতে বাঁধা দেয়
কিছু ক্ষেত্রে ইমারজেন্সি পিল জরায়ুর গলায় শ্লেষ্মা ঘন করে দেয়, যার ফলে শুক্রাণুর ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়। যেহেতু শুক্রাণু ডিম্বাণুতে পৌছাতে পারেনা সেহেতু গর্ভধারণের আর কোন সম্ভাবনা থাকেনা।
ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার নিয়ম
ইমারজেন্সি পিল সাধারণত যৌন মিলনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই খেতে হয়, তবে যদি তাঁর আগে খাওয়া যায় তাহলে সেটা সবথেকে ভালো হয়। তাছাড়া কোনোভাবে যদি ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে যায় এবং তারপর ইমারজেন্সি পিল খাওয়া হয় তাহলে এর কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাজারে নানা ধরণের ইমারজেন্সি পিল রয়েছে যেমন ৩ দিন মেয়াদী, ৫ দিন মেয়াদী এবং ২১ দিন মেয়াদী। ৩ দিনের ইমারজেন্সি পিলটি খেতে হবে যৌন মিলনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই এবং খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই প্যাকেটের গায়ে দেয়া নির্দেশনা পড়ে নিতে হবে। ৫ দিনের পিলের ক্ষেত্রে, অরক্ষিত যৌন মিলনের পর যত দ্রুত সম্ভব এই পিল গ্রহণ করলে এটি তত বেশি কার্যকর হয়। যদিও এটি ৫ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে, তবে প্রথম ২৪-৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রহণ করলে কার্যকারিতা অনেক বেশি থাকে।
২১ দিনের ইমারজেন্সি পিল খাওয়ার প্রক্রিয়াটি একটু দীর্ঘ। এ ক্ষেত্রে আপনাকে প্রতিদিন একই সময়ে একটি করে বড়ি খেতে হবে যতদিন আপনি গর্ভধারণ করতে না চান। এই প্রক্রিয়ায় সহবাসে ২১ দিন পর্যন্ত আপনাকে একটি বড়ি খেতে হবে। যদি কোনদিন ঔষধ খেতে ভুলে যান তাহলে পরেরদিন দুইটি বড়ি একসাথে খেয়ে নিতে হবে। আপনি যদি গর্ভধারণ করতে চান তাহলে পিল খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
ইমার্জেন্সি পিল কখন খেতে হয়?
ইমার্জেন্সি পিল সাধারণত একটি সময়ের বিরুদ্ধে দৌড় এর মতো। এটি কোনও রুটিন পদ্ধতি নয়, বরং শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য। ইমার্জেন্সি পিল তখনই খেতে হয়, যখন অনিরাপদ যৌনসম্পর্কের ফলে গর্ভধারণের আশঙ্কা তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে কনডম ছিঁড়ে গেলে, পিল ভুলে গেলে, যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তখনই ইমার্জেন্সি পিল গ্রহণ করা উচিত।
এটি সহবাসের পর যত দ্রুত নেওয়া হয়, তত কার্যকারিতা বেশি। যদি গর্ভধারণ ইতিমধ্যেই হয়ে যায় এবং নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে রোপিত হয়ে যায়, তাহলে এই পিল তা কোনোভাবেই আটকাতে পারে না এবং এতে চলমান গর্ভধারণের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না।
ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার পর কি হয়?
ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার পর কিছু হালকা শারীরিক ও হরমোনজনিত পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। অধিকাংশ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ১–৩ দিনের মধ্যে চলে যায় এবং বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। কারো কারো শরীরে খুব সামান্য প্রতিক্রিয়া হয়, আবার কারো ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ স্পষ্টভাবে দেখা দিতে পারে।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে সময়ের আগে বা পরে মাসিক শুরু হওয়া অর্থাৎ কারো ক্ষেত্রে মাসিক সময়ের আগেই শুরু হতে পারে এবং কারণ ক্ষেত্রে মাসিকের নির্ধারিত সময় থেকে ৫/৭ দিন পরেও শুরু হতে পারে। তবে ৩ সপ্তাহ পরও যদি মাসিক না হয় বা কোনো অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ইমার্জেন্সি পিল কাজ করে কত ঘণ্টার মধ্যে?
ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার পর এটি শরীরে কাজ করতে শুরু করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। যদি পিলটি সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে আপনি গর্ভবতী হবেন না। মনে রাখতে হবে যে, ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গর্ভনিরোধ করে না। এটি ডিম্বাণু বেরোনোর আগেই খাওয়া উচিত, কারণ ডিম্বাণু বের হয়ে গেলে পিল তেমন কাজ করে না। সাধারণত শুক্রাণু শরীরে ঢোকার পর ৫ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে, তাই দেরি না করাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
ইমার্জেন্সি পিলের দাম
বাজারে অনেক ধরণের ইমারজেন্সি পিল রয়েছে এবং তাঁদের একেকটির দাম একেক রকম। সাধারণত ইমারজেন্সি পিলের একেকটি ট্যাবলেট এর দাম ৬০ টাকা বা তাঁর বেশি হয়ে থাকে। যেমন, EC‑Pill এর একটি ট্যাবলেট এর দাম ৬৫ টাকা। এছাড়া Emcon 1 এর দাম ৬৫ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত হয়। Norix 1 এর দাম ৬৬ থেকে ৭০ টাকা এবং Norpill 1 এর দাম ৬০ থেকে ৬৪ টাকা। তবে ফেমিকন পিলের একেকটি পাতা ৩০ টাকা করে।
পিলের নাম | দাম (টাকা) |
Norpill 1 | ৬০ টাকা |
Emcon 1 | ৬৫ টাকা |
Norix 1 | ৬৬ থেকে ৭০ টাকা |
Peuli | ১৯৫ টাকা |
5X | ২০০ টাকা |
দ্রষ্টব্য:
- দামগুলো ফার্মেসি, অঞ্চল বা বিক্রেতার উপর ভিত্তি করে সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে।
- ইমার্জেন্সি পিলগুলো অরক্ষিত যৌন মিলনের ৭২-১২০ ঘণ্টার মধ্যে সেবন করতে হয় এবং এগুলো নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
FAQ
ইমার্জেন্সি পিল সেফ কিনা?
অবশ্যই! ইমারজেন্সি পিল খাওয়া নিরাপদ কারণ এটি সল্প মেয়াদে নারীদের গর্ভধারণ প্রক্রিয়াকে বাঁধা দেয়। যেহেতু এটি গর্ভপাতের মত কোন কিছু ঘটায় না সেহেতু এটি গ্রহণ করাতে কোন ঝুঁকি নেই। তবে ঘন ঘন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সামান্য কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে।
যদি আপনার লিভারের সমস্যা থাকে তাহলে এই পিল গ্রহণ কিছু সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া হয়তো আপনি এমন কিছু ঔষধ আগে থেকেই খাচ্ছেন যেগুলো পিলের কার্যকারিতা কমাতে পারে। তবে সাধারণভাবে ইমারজেন্সি পিলকে নিরাপদ গর্ভনিরোধক হিসেবেই মনে করা হয়।
২৪ ঘন্টা পর ইমার্জেন্সি পিল কাজ করে?
হ্যাঁ, ২৪ ঘণ্টা পরেও ইমারজেন্সি পিল কার্যকর থাকে। তবে এটি যত দ্রুত নেওয়া যায়, তত বেশি কার্যকর হয়। সাধারণত সহবাসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইমারজেন্সি পিল খাওয়া হলে প্রায় ৯৫% পর্যন্ত গর্ভধারণ রোধ করা সম্ভব। ২৪ ঘণ্টা পর খেলেও ক্ষতি নেই কারণ বলা হয়ে থাকে যে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ইমারজেন্সি পিল খাওয়া যায়। তবে সর্বচ্চো কার্যকারিতার জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খাওয়া উত্তম।
৩ দিন পরে ইমার্জেন্সি পিল কাজ করে?
৩ দিন পর ইমারজেন্সি পিল কাজ করবে কি করবে না সেটি নির্ভর করে আপনি কোন ধরণের পিল গ্রহণ করছেন তাঁর উপর। কিছু কিছু পিল ৭২ ঘণ্টা পর আর কাজ করেনা। অর্থাৎ এটি নিতে যদি আপনি ৭২ ঘণ্টা পার করে ফেলেন তাহলে এর কার্যকারিতা আর থাকেনা বললেই চলে।
তবে আরেক ধরণের পিল রয়েছে যেটা ৫ দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারে। এই ধরণের পিল গুলো ৭২ ঘণ্টার পর নিলেও কোন সমস্যা নেই। তবে পরামর্শ হচ্ছে সহবাসের পর আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিল নিয়ে নিন যদি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়াতে চান।
৫ দিন পরে ইমার্জেন্সি পিল কাজ করে?
উত্তর হচ্ছে ‘না’ যদি আপনি ৫ দিনের পিল ব্যবহার করে থাকেন। ৫ দিনের ইমার্জেন্সি পিল অরক্ষিত যৌন মিলনের ১২০ ঘণ্টা (৫ দিন) পর আর কার্যকর থাকে না। এই পিলগুলো সর্বোচ্চ ১২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে পিলের কার্যকারিতা প্রায় থাকে না বললেই চলে এবং এটি গর্ভধারণ প্রতিরোধে সক্ষম হবে না। তবে আপনি যদি ২১ দিনের পিল ব্যবহার করেন তবে তা স্বাভাবিকভাবেই অনেকদিন পর্যন্ত কাজ করবে।
ইমার্জেন্সি পিল কত ঘন্টার মধ্যে খেতে হয়?
আমরা আগেই বলেছি যে ইমারজেন্সি পিল আপনি যত তাড়াতাড়ি খাবেন ততই ভালো। বিশেষ করে আপনি যদি সহবাসের ৭২ ঘণ্টা বা ৩ দিনের মধ্যে পিলটি গ্রহণ করে তাহলে সেটা খুবই ভালো হয়। সবথেকে ভালো হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রহণ করলে। সাধারণত ৭২ ঘণ্টা পর পিলের কার্যকারিতা থাকেনা সেভাবে। তাই গর্ভধারণ না করতে চাইলে সময়মত গ্রহণ করাই ভালো হবে।