মা হওয়া সহজ নয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নানা শারীরিক জটিলতার মধ্যে যেতে প্রত্যেক হবু মায়েদের। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা কমে যাওয়া, পেশিতে ব্যথা, এমন নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। কারও কম, কারও ক্ষেত্রে বেশি। মূলত গর্ভে ভ্রূণের সঞ্চার হওয়ার পর থেকে সকলেরই নানা শারীরিক অস্বস্তি হয়েই থাকে, যত দিন না সন্তান পৃথিবীর আলো দেখছে।
সাধারণত গর্ভাবস্থায় মাথা ঘুরানো একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায় সমগ্র গর্ভকাল জুড়েই এই সমস্যা থাকতে পারে। আবার কারও কারও গর্ভধারণের পর থেকেই মাথা ঘুরানোর সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে গর্ভাবস্থায় সবারই মাথা ঘুরানোর সমস্যা হবে বিষয়টি এমন নয়। আজকের এই লেখাটির মাধ্যমে আমরা জানাতে চেষ্টা করবো যে গর্ভাবস্থায় কখন মাথা ঘুরানোর সমস্যা হয় এবং তাঁর জন্য কি করা উচিৎ।
আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কেন হয়
গর্ভাবস্থায় কখন মাথা ঘুরানোর সমস্যা হয়?
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরানো মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বেশি দেখা যায়। এই সময় শরীরে বড় ধরনের হরমোনগত পরিবর্তন ঘটে, বিশেষ করে প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় যা রক্তনালীগুলো শিথিল করে দেয়। এর ফলে রক্তচাপ কিছুটা কমে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। ফলে নারীদের নিয়মিত মাথা ঘোরার একটি সমস্যা তৈরি হয়। অনেক সময় সকালে খালি পেটে থাকলে বা পানিশূন্যতা দেখা দিলে মাথা আরও বেশি ঘোরে। এগুলোর প্রতিটিই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এর সাথে যদি আরও কিছু উপসর্গ দেখা দেয় বা মাথা ঘোরা তীব্র আকার ধারন করে তখন এটিকে আর সাধারণ সমস্যা বলা যাবেনা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় আমরা পরবর্তী অংশে আসছি।
গর্ভাবস্থায় কখন মাথা ঘুরানো জটিল সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়?
গর্ভাবস্থায় নানা কারণে মাথা ঘোরাতে পারে এবং এটি অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু যদি মাথা ঘোরা স্বাভাবিক না হয় বা এর সাথে আরও কোন উপসর্গ থাকে তাহলে এগুলোকে অবহেলা করা কখনোই ঠিক হবেনা। নিচে এমন কিছু উপসর্গ তুলে ধরা হলোঃ
-
ঘন ঘন বা তীব্র মাথা ঘোরানো
যদি মাথা ঘোরানো নিয়মিত ঘটে বা প্রতিবার খুব তীব্রভাবে হয়, তবে তা রক্তচাপজনিত সমস্যা, রক্তস্বল্পতা, বা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতির ইঙ্গিত হতে পারে। এটি প্লাসেন্টায় সঠিক রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, যা গর্ভের শিশুর জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে।
-
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম বা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার অনুভূতি রক্তচাপে দ্রুত পরিবর্তন বা রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার ফল হতে পারে। এতে মায়ের শরীরের পাশাপাশি গর্ভের শিশুও আঘাত পেতে পারে, বিশেষ করে পড়ে গেলে।
-
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
মাথা ঘোরার সঙ্গে চোখে ঝাপসা দেখা দেওয়া গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হতে পারে। এটি অবশ্যই চিকিৎসা করা প্রয়োজন না হলে মায়ের এবং শিশুর উভয়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
-
বুক ধড়ফড় করা
বুক ধড়ফড় বা ব্যথা হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিকতা, রক্তচাপে সমস্যা বা স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে হৃদপিণ্ডের উপর বাড়তি চাপ পড়ে, যা কারও কারও জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এটি অবহেলা করা ঠিক নয়।
-
গুরুতর মাথাব্যথা
সাধারণ মাথাব্যথা একদিকে হলে সহনীয়, কিন্তু তীব্র, লাগাতার বা হঠাৎ শুরু হওয়া মাথাব্যথা নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, মাইগ্রেন এর ইঙ্গিত হতে পারে। এর সঙ্গে মাথা ঘোরা থাকলে বিষয়টি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়। তাই দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
-
শারীরিক দুর্বলতা
শরীরের কোনো অংশ অসাড় হয়ে যাওয়া বা একপাশ দুর্বল লাগা হতে পারে স্নায়ুজনিত সমস্যা বা স্ট্রোক-এর লক্ষণ। যদিও গর্ভাবস্থায় এটি তেমন একটা হয়না। তবে এমন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
গর্ভকালীন সময়ে মাথা ঘোরা এড়াতে কি করা যেতে পারে?
গর্ভাবস্থায় আপনার শরীর অভ্যন্তরীণভাবে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শোয়া বা বসা অবস্থায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, এতে রক্তচাপ হঠাৎ কমে গিয়ে মাথা ঘোরা রোধ করা সম্ভব হয়।
মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা এড়াতে প্রতিদিন শরীরে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করাও অপরিহার্য। একজন সুস্থ গর্ভবতী নারীকে গড়ে ৮ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করতে বলা হয়। তবে চিকিৎসকের কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলে সেটাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মাথা ঘোরার সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা, গাড়ি চালানো, ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার বা পানিতে সাঁতার কাটা এড়িয়ে চলুন।
সারাদিনে অল্প অল্প করে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন, এতে গ্লুকোজের ঘাটতি কমে এবং শরীর সবল থাকে। পাশাপাশি নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করলে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়, মাথা ঘোরার প্রবণতাও কমে যায়।
একটানা অনেকক্ষণ কাজ করা এড়াতে হবে। এ সময় নারীরা একটু কাজ করলেই হাপিয়ে ওঠেন, তাই একটানা কোন কাজ করা যাবেনা। বরং কাজের মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ পা তুলে বসে বিশ্রাম নিন, চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট শুয়ে থাকুন, আর শরীরকে হাইড্রেট রাখতে মাঝে মাঝে পানি পান করুন। এই সামান্য অভ্যাসগুলো গর্ভকালীন সুস্থতা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরার সঙ্গে বমি হলে কী করণীয়?
গর্ভাবস্থায় অনেক নারী হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বমি বমি ভাব অনুভব করেন, সাথে মাথা ঘোরা। এটি সাধারণত স্বাভাবিক এবং সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে কমে যায়। মাথা ঘোরার সাথে বমি ভাব বা বমি হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। এছাড়া যে খাবার খেলে বা গন্ধ নাকে আসলে বমি ভাব হতে পারে তেমন খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
বারবার বমি হলে গর্ভবতী নারী ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েন কারণ সাথে তো মাথাঘোরা আছেই। এছাড়া যখন বমির পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায়, যেমন দিনে একাধিকবার বমি হওয়া এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাবার বা পানি ধরে রাখতে না পারা, তখন জটিল অবস্থা হিসেবেই ধরা হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ভালো।
FAQs
গর্ভাবস্থায় কোন মাসে মাথা ঘোরানোর প্রবণতা বেশি থাকে?
গর্ভাবস্থায় সাধারণত প্রথম তিন মাসে মাথা ঘোরানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি থাকে। এই সময়ে শরীরে হরমোনের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে, বিশেষ করে দুই ধরণের হরমোনের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। এর ফলে মাথা ঘোরার অনুভূতি বেড়ে যায়। তাছাড়া প্রথম তিন মাসে গর্ভবতী নারীরা অনেক সময় ক্ষুধা কমে যাওয়া, রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া, এবং পানি কম খাওয়ার কারণে দুর্বলতা অনুভব করেন, যা মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে। তিনমাসের পরেও মাথাব্যাথা থাকে, তবে প্রথম তিন মাস এটি একটু বেশিই হয়।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কি মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে?
হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা মাথা ঘোরার একটি সাধারণ কারণহিসেবে বিবেচিত হয়। গর্ভকালীন সময়ে শরীরে অতিরিক্ত রক্ত উৎপাদনের প্রয়োজন হয়, কারণ মা ও গর্ভের শিশুর উভয়ের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। প্রয়োজনীয় ভিটামিনের ঘাটতির কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যায়, ফলে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পরিবাহিত হতে পারে না। এর ফলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে গিয়ে মাথা ঘোরা দেখা দিতে পারে।