গর্ভাবস্থায় কি খেলে বাচ্চা ফর্সা হবে? বাস্তবতা ও বিজ্ঞান

আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই চান তার অনাগত সন্তানের গায়ের রং যেন উজ্জ্বল হয়। অনেকেই আবার জানতে চান যে কি গর্ভাবস্থায় কি খেলে বাচ্চা ফর্সা হবে! এমন অনেক কৌতূহলই থাকে আমাদের মায়েদের মনে। বাচ্চা ফর্সা না শ্যামলা হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে বাবা মায়ের বংশগত জিনের উপর। তারপরও আজকাল দেখা যায় বাবা মা ফর্সা না হলেও সন্তান একেবারে ধবধবে ফর্সা। আবার বাবা মা হয়তো ফর্সা কিন্তু সন্তান আশানুরূপ ফর্সা হয়না, যদিও এটি মহান আল্লাহ পাকের ফয়সালা। 

তারপরও মুরুব্বীরা এমন অনেক খাবারের নাম বলে থাকেন যেগুলো খেলে আসলেই হয়তো বাচ্চার গায়ের রঙ ফর্সা হবার সম্ভাবনা থাকে। আসলে গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের সঠিক খাদ্যাভ্যাস কেবল তার নিজের স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, গর্ভের শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু মায়ের খাবার বাচ্চার উপরেও প্রভাব ফেলে সেহেতু খাবারের ব্যাপারে একটু সচেতন হওয়া ভালো। চলুন এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানি। 

আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কেন হয়

গর্ভাবস্থায় কি খেলে বাচ্চা ফর্সা হয়?

শিশুর গায়ের রঙ নিয়ে বাবা মায়ের কৌতূহল স্বাভাবিক, আর আমাদের সমাজে ফর্সা গায়ের রঙের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। এই কারণে গর্ভাবস্থায় এমন অনেক প্রচলিত ধারণা চালু আছে যে, নির্দিষ্ট কিছু খাবার খেলে নাকি বাচ্চার গায়ের রঙ ফর্সা হয়। বাচ্চার গায়ের রঙ শতভাগ নির্ভর করে জেনেটিক্সের ওপর, অর্থাৎ সে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে কোন জিন পেয়েছে তার ওপর। কার ত্বকে কতটুকু মেলানিন তৈরি হবে, তা জিনের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। 

মায়ের খাদ্যাভ্যাস এই জেনেটিক প্রক্রিয়াকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে না। সহজভাবে বললে, এটি হলো প্রকৃতির এক অনন্য শিল্পকর্ম, যেখানে খাবারের কোনো রঙ তুলির আঁচড় দিতে পারে না। তারপরও আমরা গর্ভবতী মায়েদের জন্য কিছু খাবারের পরামর্শ দিতে পারি যেগুলো কিনা প্রচলিত ধারণা অনুসারে বাচ্চার রং গঠনের উপর প্রভাব ফেললেও ফেলতে পারে। 

  • বলা হয় যে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত দুধ বা দুধের সাথে জাফরান মিশিয়ে খেলে নাকি শিশুর গায়ের রঙ ফর্সা হয়।
  • বিশেষ করে গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ডিমের সাদা অংশ খেলে নাকি বাচ্চার ত্বক উজ্জ্বল ও ফর্সা হয়।
  • অনেকে মনে করেন কমলা, লেবু, কিউই এবং বেরি জাতীয় ফলগুলোতে
  • থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শিশুর ত্বককে ফর্সা ও উজ্জ্বল করে।
  • কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন, বাদাম খেলে শিশুর গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয়।

এগুলোর প্রতিটিই পুষ্টিকর খাবার এবং একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই দরকারি। এগুলো নিয়ম মেনে খেলে গর্ভের বাচ্চা যথেষ্ট পুষ্টি পাবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর যথেষ্ট পুষ্টি পাওয়া একজন বাচ্চার গায়ের রং উজ্জ্বল হতেই পারে, তবে হবেই এমন কোন কথা নেই। পরিশেষে একটি সুস্থ সবল বাচ্চাই সকলের কাম্য। 

ডাক্তাররা গর্ভাবস্থায় শিশুর গায়ের রং নিয়ে কী বলেন?

ডাক্তাররা গর্ভাবস্থায় শিশুর গায়ের রং নিয়ে সাধারণত যে বিষয়টি জোর দিয়ে বলেন তা হলো, শিশুর গায়ের রঙ সম্পূর্ণভাবে তার বাবা-মায়ের জিনের ওপর নির্ভরশীল এবং এটি মায়ের খাদ্যাভ্যাস বা জীবনযাত্রার কোনো নির্দিষ্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ডাক্তাররা ব্যাখ্যা করেন যে, শিশুর গায়ের রং নির্ধারণ করে তার শরীরে থাকা মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ। এই মেলানিন উৎপাদনের মাত্রা এবং ধরন সাধারণত বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

তাই, বাবা মা উভয়ের জিনের সংমিশ্রণেই শিশুর গায়ের রং তৈরি হয়, তবে পূর্বপুরুষদের জিনের কারণেও ভিন্নতা আসতে পারে। ডাক্তারদের মতে শিশুর গায়ের রং এর ব্যাপারটি বাবা মা বা বংশের অন্য কারো সাথে মিলে যেতে পারে। বাবা মায়ের মত না হলেও দাদী বা নানী বাড়ির অন্য কারো সাথেও মিলতে পারে। এটি আসলে কখনোই নির্ধারিত করে বলা যায় না যে বাচ্চা তাঁর বাবা বা মায়ের মতোই হবে। এমনকি ডাক্তাররা খাবারের কারণে গায়ের রং ফর্সা হয় কিনা সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোন নিশ্চয়তা দেন না। 

গর্ভাবস্থায় কী ধরনের পুষ্টি শিশুর ত্বকের গঠন উন্নত করতে সাহায্য করে?

nutritious food during pregnancy

গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টি কেবল শিশুর সামগ্রিক বৃদ্ধিই নয়, বরং তার ত্বকের গঠন ও সৌন্দর্যেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। গর্ভের শিশুর ত্বক তখনই সুস্থ ও ভালোভাবে গঠিত হয়, যখন মা প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও পুষ্টিকর উপাদান যথাযথ পরিমাণে গ্রহণ করেন। যেমন, ভিটামিন A ও C ত্বকের কোষ গঠন ও কোলাজেন তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া ভিটামিন E ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

এছাড়া পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ শিশুদের ত্বক, চুল, নখসহ সকল কোষের বিকাশে সাহায্য করে। একইসাথে একজন গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পানি পান করাও অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, এসব পুষ্টি উপাদান শিশুর গায়ের রং নির্ধারণ না করলেও তার ত্বকের গঠন ও স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তাই গর্ভাবস্থায় মায়ের সুষম খাদ্যাভ্যাসই একটি সুস্থ ও উন্নত ত্বকসম্পন্ন শিশুর ভিত্তি তৈরি করে।

FAQs

বাচ্চার গায়ের রং কি শুধুই মায়ের খাবারের উপর নির্ভর করে?

না, বাচ্চার গায়ের রং শুধুমাত্র মায়ের খাবারের উপর নির্ভর করে না। পর্যাপ্ত পানি খেলে মায়ের শরীর ডিটক্সিফাই হয়, যার প্রভাব শিশুর ত্বকে পড়তে পারে। পাশাপাশি, প্রোটিন কোষ গঠনের মূল উপাদান হওয়ায় এটি শিশুর ত্বকসহ সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

গর্ভাবস্থায় ফলমূল বেশি খেলে কি বাচ্চা ফর্সা হয়?

কোনো নির্দিষ্ট ফল বা খাবার শিশুর গায়ের রঙ ফর্সা করতে পারে এমন কোন প্রমাণ আসলে কেউ করতে পারেনা। তবে, কিছু পুষ্টিকর খাবার মা এবং শিশুর সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং ত্বকের সুস্থ বিকাশের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষ করে ফলমূল। এগুলো খেলে মায়ের সাথে গর্ভস্থ বাচ্চাও সুস্থ থাকবে। আপনারা অবশ্যই জানেন যে সুস্থ এবং ভালো সাস্থ্যের অধিকারী যেকোনো বাচ্চা বা মানুষই সুন্দর গায়ের রং ধারন করতে পারেন। 

নবজাতকের ত্বকের রঙে সাময়িক পরিবর্তন হবার কারণ কি? 

জন্মের সময় শিশুর ত্বকের রঙ বিভিন্ন কারণে ভিন্ন হতে পারে। যেমন, জন্মের পরপরই শিশুর ত্বক কিছুটা লালচে বা বেগুনি দেখায় রক্ত ​​সঞ্চালনের কারণে। কিছু শিশুর জন্মগতভাবে হালকা রং থাকতে পারে যা কয়েক মাস বা ৬ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। পরে তাদের প্রকৃত গায়ের রঙ প্রকাশ পায়। এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং প্রায় প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই এটি ঘটে। এরপর সময়ের সাথে সাথে মেলানিন উৎপাদন বাড়লে ত্বকের রং স্থায়ী হয়। তবে নবজাতকের গায়ের রং হলুদ হয়ে যাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয় কারণ জন্ডিসের কারণে এমনটা হয়। এটি হলে অবশ্যই চিন্তার বিষয় এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

বংশগতির পাশাপাশি শিশুর গায়ের রঙে আর কী কী বিষয় ভূমিকা রাখে?

জন্মের পর শিশুর ত্বক যখন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসে, তখন মেলানিন উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। এ কারণে, যেসব শিশুর ত্বক সহজাতভাবে একটু শ্যামলা হবার কথা। জন্মের সময় তারা যতটা ফর্সা দেখায়, সময়ের সাথে সাথে তাঁদের গায়ের রং একটু গাঢ় হতে পারে। তাই শিশুকে অতিরিক্ত সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করা উচিত।

শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস বদলে শিশুর গায়ের রঙে কি সত্যিই পরিবর্তন আনা সম্ভব?

অনেক সমাজে কিছু খাবার যা খেলে বাচ্চা ফর্সা হয় এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে। ডাক্তাররা পরিষ্কারভাবে জানান যে, শিশুর গায়ের রঙ জেনেটিক্স দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং আপনার খাদ্যাভ্যাস বা অন্য কোনো বাহ্যিক উপায়ে তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মা ও শিশুর সুস্থ থাকা।

শেষে বলতে চাই, শুধুমাত্র ত্বকের সৌন্দর্যই কোন মানুষের একান্ত আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হতে পারে না। গর্ভবতী মায়ের উচিৎ সুস্থ, মেধাবী ও স্বাভাবিক শিশু জন্মের জন্য চেষ্টা করা। তাই পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের সাথে সাথে নিজের জীবনধারাতেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

Author

  • ডাঃ তানহা একজন নিবেদিতপ্রাণ মেডিসিন ও গাইনী বিশেষজ্ঞ, যিনি বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অভ্যন্তরীণ রোগ ও নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তিনি নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য প্রচারে বিশ্বাসী। Emergencypillbd.com-এ তিনি নিয়মিতভাবে প্রেগন্যান্সি, পিরিয়ড, ইমার্জেন্সি পিল এবং নারীস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা শেয়ার করে থাকেন, যা নারীদের সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

Leave a Comment