আমাদের দেশে এখনও মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা অনেকের জন্য অস্বস্তির বিষয়। শুধু মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও এই বিষয়ে যথেষ্ট অজ্ঞ এবং অনেকে এ নিয়ে সচেতন নয়। সামাজিকভাবে এটি যেন একটি গোপন বিষয়, এমন ধারণা এখনো রয়ে গেছে। অথচ পিরিয়ড কোনো লজ্জার বিষয় নয়, এটি প্রতিটি নারীর শরীরের একদম স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়া। তাই এ নিয়ে কথা বলা, জ্ঞান অর্জন করা বা সচেতনতা বৃদ্ধি করা নিয়ে কোনো দ্বিধা বা সংকোচ থাকার কথা নয়।
বরং সময় এসেছে পিরিয়ডকে স্বাভাবিকভাবে দেখার, বুঝার এবং তা নিয়ে শিক্ষিত ও সহানুভূতিশীল হওয়ার। পিরিয়ড নিয়ে বিস্তারিত জানাতেই আমাদের আজকের এই লেখাটি। এখানে আপনারা জানবেন পিরিয়ড কী, পিরিয়ড কেন হয়, পিরিয়ড কত দিন থাকে ইত্যাদি সম্পর্কে যাতে আপনাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা হতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ মানে কি?
পিরিয়ড কী?
একজন নারীর দেহে প্রতি মাসে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু অপ্রয়োজনীয় রক্ত ও টিস্যু জরায়ু থেকে বের হয়ে আসে, এটিকেই আমরা মাসিক বা পিরিয়ড বলে থাকি। নারীর দেহে বাচ্চা ধারণের জন্য জরায়ু প্রতি মাসে নিজেকে প্রস্তুত করে, সেখানে একটি স্তর গঠিত হয় যা ভ্রূণের জন্য নিরাপদ আবরণ তৈরি করে। কিন্তু যদি সেই মাসে ডিম্বাণু নিষিক্ত না হয়, অর্থাৎ গর্ভধারণ না ঘটে, তাহলে সেই তৈরি হওয়া স্তরটি আর প্রয়োজন হয় না। ফলে এটি রক্ত ও অন্যান্য তরলের মাধ্যমে যোনিপথ দিয়ে দেহের বাইরে চলে আসে। সহজভাবে বললে, মেয়েদের শরীরে হরমোনের কারণে প্রতি মাসে এক ধরনের পরিবর্তন হয়, যার ফলে যোনিপথ দিয়ে রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত তরল পদার্থ নির্গত হয়, এটাই হলো মাসিক বা ঋতুস্রাব।
তাই যখন কোনো নারীর মাসিক হয়, তখন তা মূলত শরীরের এমন কিছু রক্ত ও টিস্যু নিঃসরণ, যা তার আর প্রয়োজন নেই। একজন মেয়ে যখন ধীরে ধীরে পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠেন এবং শারীরিকভাবে পরিপক্বতা অর্জন করেন, তখন থেকেই এই পিরিয়ড তার জীবনের একটি নিয়মিত অংশ হয়ে ওঠে। এটি নারীর শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রক্রিয়ারই একটি অংশ।
পিরিয়ড কেন হয়?
পিরিয়ড নারীদেহের একটি স্বাভাবিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। সময়মত এটি হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি মাসে একজন সুস্থ নারীর শরীরে একটি ডিম্বাণু তৈরি হয়। গর্ভধারণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে জরায়ুর ভেতরের আস্তরণ তখন ধীরে ধীরে পুরু হতে থাকে, যেন ভ্রূণ তৈরি হলে তাকে আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু যদি সেই ডিম্বাণু নিষিক্ত না হয়, তাহলে শরীর বুঝে ফেলে সেই পুরু আস্তরণ আর দরকার নেই। ফলে সেই টিস্যুগুলো রক্তের সঙ্গে জরায়ু থেকে যোনিপথ দিয়ে স্বাভাবিক উপায়েই বের হয়ে যায়।
পিরিয়ড কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যবান নারীদেহের পরিচয়। এটি নারীদেহের হরমোন ও প্রজনন ব্যবস্থার সুষ্ঠু কার্যক্রমকে নির্দেশ করে। পিরিয়ড আছে বলেই নারী দেহের সুস্ততা আছে। অতএব নিয়মিত পিরিয়ড হওয়া জরুরী, বরং এটি নিয়মিত না হওয়াই অস্বাভাবিক।
পিরিয়ড কত দিন থাকে?
পিরিয়ড বা মাসিক সাধারণত প্রতি মাসে একবার হয় এবং এটি গড়ে ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রথম কয়েক দিন রক্তপাত তুলনামূলকভাবে বেশি হয়, এরপর ধীরে ধীরে তা কমে যায়। কেউ কেউ হয়তো ২ দিনেই পিরিয়ড শেষ করে ফেলেন, আবার কারও ক্ষেত্রে তা ৭ দিন বা তারও বেশি স্থায়ী হতে পারে। যদিও ৩ থেকে ৭ দিন পিরিয়ড থাকা স্বাভাবিক ধরা হয়, তবুও যদি রক্তপাত ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয় অথবা অত্যাধিক ভারী রক্তপাত হয় তাহলে এখানে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
পিরিয়ডের সময় মেয়েরা কখনও হালকা রক্তপাত, কখনও গাঢ় রঙের জমাট রক্ত, আবার কখনও হালকা বাদামি রঙের স্রাবও লক্ষ্য করতে পারেন। এগুলোর সবই স্বাভাবিক যদিও সবার ক্ষেত্রে একই রকম ভাবে হয়না। তবে নিয়মিত এবং স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে পিরিয়ড হওয়া একজন নারীর সুস্থতার একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ।
পিরিয়ডের সময় শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়?
মাসিক বা পিরিয়ড চলাকালে নারীদের শরীরে বেশ কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায়, যা মূলত হরমোনের ওঠানামার কারণে হয়ে থাকে। এগুলো প্রায় সবার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, তাই ভয়ের কিছু নেই। কি কি পরিবর্তন দেখা দেয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
-
কোমর ও পেটের ব্যথা
পিরিয়ডের সময় অনেকেই পেট ও কোমরের ব্যথা হয়। কারও ক্ষেত্রে এই ব্যথা হালকা হয়, আবার কারও ক্ষেত্রে তীব্র ও অসহনীয় হতে পারে। অনেক সময় এই ব্যথা পিঠেও ছড়িয়ে পড়ে।
-
মাথাব্যথা ও বমিভাব
পিরিয়ডের সময় বমি ভাব ও মাথাব্যাথা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যাঁরা মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের মাথাব্যথা এই সময়ে আরও বেড়ে যেতে পারে। অনেকের মাথাব্যথা এত তীব্র হয় যে, তাঁরা বিছানা থেকেই উঠতে পারেন না।
-
শারীরিক দুর্বলতা
পিরিয়ডের সময় রক্তক্ষরণের ফলে শরীর থেকে আয়রন কমে যেতে পারে, যার কারণে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব হয়। আবার অনেকেরই রক্তপাত অনেক বেশি হওয়ার কারণেও শরীর দুর্বল হতে পারে। যদি বেশি দুর্বলতা দেখা দেয় তাহলে বিশ্রাম নিতে হবে।
-
স্তনে ব্যথা
পিরিয়ডের সময় কখনও স্তনে ভারী লাগতে পারে, এমনকি সামান্য ছোঁয়াতেও অস্বস্তি অনুভব হয়। কারো কারো খুব ব্যাথা অনুভূত হয়। মূলত পিরিয়ডের আগে থেকেই অনেকেই স্তনে ব্যাথা অনুভব করেন। এটিকে পিরিয়ড শুরু হওয়ার লক্ষণ হিসেবেও ধরা যায়।
-
মুড সুইংস করা
পিরিয়ডের সময় হঠাৎ মন খারাপ, কান্না পাওয়া, রাগ হওয়া, একা থাকতে চাওয়া বা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া, এসব পরিবর্তন বেশ সাধারণ। এটি অনেক নারীর দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। সবারই যে এটা হয় তা নয়, তবে কিছু নারীর মুড ঘন ঘন পরিবর্তন হয় পিরিয়ডের সময় গুলোতে।
-
বদহজম হওয়া
মাসিকের সময় অনেকের হজমশক্তি কমে যায় এবং গ্যাস হতে পারে। ফলে কিছু খেলে পেট ফুলে ওঠা বা অসস্তি হওয়া এগুলো চলতে থাকে। এগুলো একেবারেই স্বাভাবিক। পিরিয়ড কমার সাথে এটাও আসতে আসতে কমে যায়। ত্যবে এ সময় যতটুকু পারবেন ততটুকুই খাবেন, অতিরিক্ত খাবার দরকার নেই।
পিরিয়ড সম্পর্কে ছেলেদের জানা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পিরিয়ড শুধুমাত্র নারীদের শরীরের একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হলেও, এটি সম্পর্কে ছেলেদের জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে এখনও মাসিক নিয়ে ভুল ধারণা ও লজ্জার কারণে মেয়েরা মানসিক চাপ ও অপমানের শিকার হয়। যদি ছেলেরাও পিরিয়ড সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে, তবে তারা এই বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে এবং নারীদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে শিখবে।
বিদ্যালয়, পরিবার, কর্মক্ষেত্র কিংবা বন্ধুত্ব প্রায় সব জায়গাতেই ছেলেরা নারীদের পাশে থাকে। তাই পিরিয়ডের সময় মেয়েরা যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, তা বুঝতে পারলে ছেলেরা আরও সহানুভূতিশীল হতে পারবে তাঁদের প্রতি।
ছেলেরা যদি এ বিষয়ে সচেতন হয়, তাহলে সমাজে পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু দূর হবে, মেয়েরা হবে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। সুতরাং, একটি সুস্থ ও সমতার সমাজ গড়তে হলে পিরিয়ড সম্পর্কে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের যথাযথ জ্ঞান থাকাও অত্যন্ত জরুরী।
কেন আমাদের সমাজে এখনো পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা কম হয়?
আমাদের সমাজে এখনও পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা কম হয় কারণ বহু প্রাচীনকাল থেকে পিরিয়ডকে একধরনের লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে অনেক পরিবারে ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা শিখে যায়, পিরিয়ড নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা অনুচিত। তাছাড়া পুরুষদের মধ্যে এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা ও শিক্ষা না থাকায় মেয়েরা নিজেও সংকোচ বোধ করে। ফলে মেয়েরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে বঞ্চিত হয় এবং পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা হলে সেটি গোপন রাখে, যার ফলে পরে বড় ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
FAQs
পিরিয়ড কত দিন পর পর হয়?
পিরিয়ড সাধারণত ২৮ থেকে ৩০ দিন পর পর হয়ে থাকে। এই হিসেবটা করা হয় আপনার মাসিকের প্রথম দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী মাসিকের প্রথম দিন পর্যন্ত। তবে পিরিয়ডের প্রথম দিক অর্থাৎ কিশোরী বয়সে যে পিরিয়ড শুরু হয় সেটা কিছুটা অনিয়মিত থাকে। এর কারণ হচ্ছে এ সময় শরীরের হরমোনের ভারসাম্য তৈরি হতে কিছুটা সময় নেয়। যদি আপনার মাসিক চক্রের দৈর্ঘ্য ২১ দিনের কম বা ৩৫ দিনের বেশি হয় তাওলে এটি অনিয়মিত পিরিয়ড।
পিরিয়ডের রক্ত কোথা থেকে আসে?
পিরিয়ডের রক্ত আসে নারীর জরায়ু থেকে। প্রতি মাসে গর্ভধারণের জন্য জরায়ুর ভিতরে একটি নরম ও রক্তযুক্ত স্তর তৈরি হয়। যদি ওই মাসে গর্ভ না ধরে, তাহলে ওই অতিরিক্ত স্তর ও রক্তকে ভেঙে যায় এবং যোনিপথ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। তাই পিরিয়ডের রক্ত শুধু রক্ত নয়, এতে টিস্যুর ছোট ছোট অংশও থাকে।
পিরিয়ডের সময় প্রতিবার কতটা রক্তপাত হলে তা স্বাভাবিক ধরা হয়?
সাধারণভাবে, একজন নারীর প্রতিবার পিরিয়ডে মোট ৩০ থেকে ৮০ মিলিলিটার পর্যন্ত রক্তপাত হয়, যা প্রায় ২ থেকে ৫ টেবিল চামচের সমান। তবে যদি প্রতি ঘণ্টায় একটি করে প্যাড ভিজে যায়, কিংবা রক্তপাত টানা সাত দিনের বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে তা অস্বাভাবিক রক্তপাত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা বা রক্তশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই তা চিন্তার বিষয়। রক্তপাতের এমন অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
মাসিক বা পিরিয়ড কী নিয়মিত হওয়া উচিত?
হ্যাঁ, পিরিয়ড নিয়মিত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিরিয়ড নিয়মিত হওয়া সুস্থতার লক্ষণ। কোন মেয়ের পিরিয়ড ঠিকমত না হলে অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় যে মেয়েরা অন্য কোন শারীরিক জটিলতা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার শুরুতেই জিজ্ঞেস করেন যে মাসিক নিয়মিত হয় কিনা কারণ মাসিক নিয়মিত হওয়া বা না হওয়ার সাথে শরীরের অন্যান্য কার্যাবলীও জড়িত।