গর্ভাবস্থা নারীর জীবনে এক অনন্য ও আনন্দময় সময়, তবে এ সময় শরীরে নানা রকম পরিবর্তনের ফলে কিছু অস্বস্তিও দেখা দিতে পারে। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন যে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা কি স্বাভাবিক? আসলে পেটে হালকা ব্যথা বা টান লাগার অনুভূতি অনেক গর্ভবতী নারীর মধ্যেই দেখা যায়, যা সাধারণত স্বাভাবিক। তবে সব ব্যথা যে ক্ষতিকর নয়, তা যেমন ঠিক, তেমনি কিছু ব্যথা হতে পারে গভীর কোনো শারীরিক সমস্যার ইঙ্গিত।
তাই পেটের ব্যথার ধরন ও তীব্রতা সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আর্টিকেল এ আমরা এই বিষয়টিই আলোচনা করবো। ব্যাথা কেন হয়, কোন সময় চিন্তার প্রয়োজন নেই এবং কখন এটি গুরুতর হতে পারে তার বিস্তারিত তুলে ধরবো এই লেখাটিতে।
আরও পড়ুনঃ প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ মানে কি?
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা কি স্বাভাবিক?
গর্ভাবস্থায় পেটে হালকা ব্যথা একটি স্বাভাবিক ও সাধারণ অবস্থা, যা অধিকাংশ গর্ভবতী নারীই অনুভব করেন। গর্ভধারণের শুরুতেই শরীরে নানা শারীরিক ও হরমোনজনিত পরিবর্তন শুরু হয়। জরায়ু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, ফলে আশপাশের পেশি ও লিগামেন্টগুলো প্রসারিত হয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয়। এর ফলে পেটের নিচের দিকে টান বা হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
এছাড়া গ্যাস জমে থাকা, বা হজমের সমস্যাও পেটে ব্যথা বা অস্বস্তির অন্যতম কারণ হতে পারে। কারণ, গর্ভের ভেতরে শিশুর বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিপাকতন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে, ফলে হজমের গতি কমে যেতে পারে। আবার কখনও এই ব্যথা বিশ্রাম নিলে বা অবস্থান পরিবর্তন করলে সহজেই কমে যায়। তবে ব্যথা যদি তীব্র হয়, বা সাথে রক্তপাত, জ্বর দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
গর্ভাবস্থায় কোন ধরনের ব্যথা স্বাভাবিক ধরা হয় না?
গর্ভাবস্থায় হালকা ব্যথা অনেক সময় স্বাভাবিক হলেও কিছু ব্যথা একদমই অবহেলা করা উচিত নয়। বিশেষ করে তীব্র, ধারালো বা হঠাৎ শুরু হওয়া ব্যথা কখনোই সাধারণ নয়। যদি পেটের নিচে তীব্র ব্যথা হয় বা ব্যথার সঙ্গে রক্তপাত দেখা যায়, তবে তা গর্ভপাত সম্পর্কিত জটিলতার লক্ষণ হতে পারে। আবার গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পিরিয়ডের মতো নিয়মিত ব্যথা হতে পারে যা সময়ের আগেই প্রসবের সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
তাছাড়া পিঠের নিচে তীব্র ব্যথা হলে কিডনি সংক্রমণ বা প্রসব শুরু হওয়ার আশঙ্কাও থাকতে পারে। গর্ভাবস্থায় নিজের ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতার জন্য শরীরের প্রতিটি সংকেতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। যেওন অস্বাভাবিক অবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
হালকা ব্যথার সময় কোন ঘরোয়া উপায় নেওয়া যেতে পারে?
গর্ভাবস্থায় হালকা পেট ব্যথা অনেক সময় কিছু ঘরোয়া উপায়ে উপশম করা সম্ভব। অতিরিক্ত হাঁটা বা কাজ করলে পেটের পেশিতে চাপ পড়ে। এক্ষেত্রে একপাশে কাত হয়ে বিশ্রাম নেওয়া ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। কোমর বা পেটের নিচের অংশে হালকা গরম পানির ব্যাগ সেঁক দিলে পেশির ব্যথা কমতে পারে। এছাড়া শরীরে পানিশূন্যতা থাকলে পেশি আরও শক্ত হয়ে ব্যথা বাড়তে পারে। তাই নিয়মিত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে।
মাঝে মাঝে ব্যায়াম করতে পারেন। এটি হজমে সহায়তা করে ও পেট গ্যাসের কারণে যে অস্বস্তি হয়, তা কমায়। তবে ব্যায়াম করতে হবে ধীরে ধীরে ও চিকিৎসকের অনুমতিক্রমে। অনেকসময় দেখা যায় যে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকেও পেট ব্যথা হতে পারে। একজন গর্ভবতী মা কে যতটা সম্ভব চাপমুক্ত রাখতে হবে।
গর্ভাবস্থার কোন মাসে পেট ব্যথা সবচেয়ে বেশি হতে পারে?
সাধারণত গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই হালকা পাতলা পেটে ব্যাথা হয়। এছাড়া সন্তান জন্মদানের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ব্যাথা হতে পারে। প্রথম ৩ মাস ব্যাথা হওয়ার কারণের সাথে পরবর্তী মাসগুলোতে ব্যাথা হওয়ার কারণ নাও মিলতে পারে। গর্ভধারণ করার পর শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে বিধায় মাঝে মধ্যে পেটে ব্যথা অনুভূত হয়, তবে এটা চিন্তার বিষয় না।
৪ থেকে ৬ মাস সময়ে জরায়ু বড় হতে থাকে এবং আশপাশের লিগামেন্ট টান পড়ে। এর ফলে তলপেটে ব্যাথা হতে পারে। এরপর যত সময় যায় বাচ্চা বড় হতে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবেই পেটের আশেপাশে নানা অংশে চাপ পড়ে। এর চাপের কারণে পেটে ব্যাথা হয়ে থাকে। তবে যদি অন্যান্য কোন গুরুতর উপসর্গ না দেখা দেয় তাহলে চিন্তার কোন কারণ নেই।
FAQs
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা কি সব সময়ই বিপদের লক্ষণ?
না। আগেই বলেছি যে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যাথা একটি স্বাভাবিক অবস্থা যদি সেটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। আপনার শরীর যখন গর্ভাবস্থার সাথে মানিয়ে নেয় এবং শিশু বাড়তে থাকে, তখন পেটে বিভিন্ন ধরনের হালকা ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা খুবই সাধারণ। তবে ক্রমাগত ব্যাথা, জ্বর, রক্তপাত, মাথা ব্যাথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয় সেক্ষেত্রে এগুলো অবহেলা করা উচিৎ হবেনা।
পেট ব্যথা হলে গর্ভবতী নারীকে কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
সাধারণ বা হালকা পেট ব্যাথায় ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন নেই, ঘরোয়া উপায় বা সাবধানতায় এটি উপশম হতে পারে। তবে একাধারে তীব্র ব্যাথা এবং অসস্তি থাকলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সাধারণত গর্ভাবস্থায় কোন বড় কারণ ছাড়া এমন ব্যাথা হবার কথা না, তাই ব্যাথা যদি দীর্ঘ সময় ধরে হতে থাকে তাহলে অবশ্যই এটিকে হেলাফেলা করা যাবেনা কারণ মায়ের সাথে বাচ্চার সুস্ততাও জড়িত। তাই এমতাবস্থায় দ্রুত গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
গ্যাস বা হজম সমস্যা কি গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথার কারণ হতে পারে?
হ্যাঁ, এর কারণেও পেটে ব্যাথা হতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায়ই যেকোনো মানুষের হজমে সমস্যা হলে পেট ব্যাথা করে। আর একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য তো গ্যাস আরও ভয়াবহ জিনিস কারণ এমনটা হলে সে আরও বেশি কষ্ট পায়। গর্ভাবস্থায় হজমে সমস্যা হলে পেটে ব্যাথা হয়ে থাকে, এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেতে হবে এবং হজমে সমস্যা করে এমন খাবার খাওয়া যাবেনা।
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যাথা মানেই কি প্রসবের ব্যাথা?
না, কারণ গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে বা ৪ – ৬ মাসে যে ব্যাথা হয় সেটা কখনোই প্রসবের ব্যাথা হতে পারেনা। এই সময়ে সাধারণত কোন বাচ্চা জন্ম নেয় না। তাই ব্যাথা মানেই প্রসব বেদনা ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই। তবে ৯ মাসের সময় যদি ব্যাথা হয় তাহলে এবং এটি তীব্র হতে থাকে তাহলে এটিকে প্রসব এর ব্যাথা হিসেবে ধরা যেতে পারে, তারপরও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।