আমাদের সমাজে এখনো পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা অনেক পরিবারে ট্যাবু হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে অনেক মেয়ে লজ্জার কারণে পরিবারের কারো সাথে আলোচনা করতে পারে না। তাঁরা সর্বদা এটাই ভেবে চলে যে পিরিয়ড নিয়ে কীভাবে পরিবারের সাথে কথা বলব? এর ফলেই তারা সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারে না এবং অজ্ঞতার কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগে থাকে।
পিরিয়ড নিয়ে এখন সবাই অনেকটাই সচেতন, তবে এ সময় পরিবারের সাথে লুকোচুরি না করে শেয়ার করতে পারাটাও একটা বড় পাওয়া। সচেতনতা মানে এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে মেয়েরা নির্দ্বিধায় বলতে পারে “আমার মাসিক চলছে” বা “আমার স্যানিটারি ন্যাপকিন দরকার”। এ ধরনের খোলামেলা মনোভাব মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। অতএব, পিরিয়ড নিয়ে নীরবতা ভাঙা এখন সময়ের দাবি। আজকের লেখার মাধ্যমে আমরা এই বিষয়টিই তুলে ধরবো।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের সময় স্ট্রেস কমানোর উপায় কী?
পিরিয়ড নিয়ে কীভাবে পরিবারের সাথে কথা বলা যায়?
পিরিয়ড নিয়ে কীভাবে পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন। কেউ কেউ পুরো পিরিয়ডের সময়টিতে একেবারেই চুপচাপ থাকেন এবং অনেকটা গোপন ভাবেই দিনগুলো পার করেন। যারা বুঝতে পারেন না যে পরিবারের সদস্যদের সাথে কীভাবে কথা বলা যায় তাঁদের জন্য আমরা কিছু উপায় উল্লেখ করছি। আশা করি, এগুলো আপনার সহায়ক হবেঃ
-
আত্মবিশ্বাস বজায় রাখুন
পিরিয়ড নিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলতে গেলে প্রথমেই মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। অনেকেই লজ্জা বা সংকোচ বোধ করে, কিন্তু মনে রাখা দরকার যে এটি একেবারেই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তাই লুকিয়ে রাখার কিছু নেই, বরং খোলাখুলি বললে সঠিক সহায়তা পাওয়া যায়।
-
বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিকে বেছে নিন
প্রথমে যাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাঁর সাথে শেয়ার করতে পারেন। সাধারণত মা, বড় বোন বা খালার মতো কাছের মানুষদের কাছে বলা সহজ হয়। পরে চাইলে ধীরে ধীরে বাবার সাথেও এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
-
সহজ কথায় শুরু করুন
আলাপ শুরু করার জন্য জটিল বা লজ্জাজনক শব্দ ব্যবহার করার দরকার নেই। আপনি প্রতিদিন যেভাবে সবার সাথে কথা বলেন সেভাবেই বলুন। জিজ্ঞেস করুন আপনার এখন কি করা উচিত, বা কি করলে ব্যথা উপশম হবে ইত্যাদি।
-
দ্বিধা ছাড়াই প্রয়োজনীয় জিনিস চেয়ে নিন
অনেক সময় মেয়েরা লজ্জার কারণে সরাসরি ন্যাপকিন বা অন্যান্য জিনিস চাইতে পারে না। স্পষ্টভাবে নিজের প্রয়োজন জানালে পরিবার আপনাকে সহযোগিতা করতে পারবে, আর আপনি স্বস্তি অনুভব করবেন। তাই পরিষ্কার ভাবেই জানান যে আপনার কী কী দরকার।
-
বাবা বা ভাইয়ের সাথেও আলোচনা করুন
পরিবারে ভাই বা বাবার কাছেও বিষয়টি জানানো জরুরি। অনেক সময় জরুরি মুহূর্তে তারাই দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন এনে দিতে পারে, কিংবা অন্যভাবে সহায়তা করতে পারে। পিরিয়ড নিয়ে যদি তারা ছোটবেলা থেকেই জানে, তবে বিষয়টি তাদের কাছেও স্বাভাবিক মনে হবে।
কেন পরিবারের সাথে পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন?
এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে অনেক অর্থাৎ এই প্রশ্নের বিপরীতে অনেক যুক্তি আমরা দেখাতে পারবো। পিরিয়ড লুকিয়ে রাখার কোন জিনিস নয়, বিশেষ করে নিজের পরিবারের কাছে। যদি সব দিক দিয়ে স্বস্তি পেটে চান তাহলে পরিবারের সাথে শেয়ার করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। কেন শেয়ার করবেন পরিবারের সাথে? জেনে নিনঃ
-
ট্যাবু ভাঙার জন্য
পরিবারের ভেতর থেকে যদি পিরিয়ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা শুরু হয়, তবে ধীরে ধীরে ট্যাবু ভেঙে যাবে। সার্বিক দিক বিবেচনায় ট্যাবু ভেঙ্গে ফেলা এখন সময়ের দাবী। তাই পরিবার থেকেই শুরু হওয়া দরকার এই ট্যাবুর ভাঙ্গন।
-
শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য
যদি মেয়েরা পরিবারের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে না পারে, তবে তারা বাধ্য হয় পুরনো কাপড় বা অস্বাস্থ্যকর উপায় ব্যবহার করতে। অথচ পরিবারের সহযোগিতা পেলে স্যানিটারি ন্যাপকিন, ব্যথা উপশমের ব্যবস্থা সহজেই পাওয়া সম্ভব।
-
মানসিকভাবে চাপমুক্ত হতে
লজ্জা বা সংকোচে পরিবারের সাথে কথা না বলতে পারলে সেই চাপ আরও বেড়ে যায় এবং একাকিত্ব তৈরি হয়। কিন্তু পরিবার যদি অবগত থাকে, তবে তারা মানসিকভাবে সমর্থন দেবে, পাশে দাঁড়াবে এবং মেয়েরা স্বস্তি বোধ করবে।
-
সচেতনতা বৃদ্ধি করতে
অনেক মেয়ে প্রথমে জানেই না যে পিরিয়ড কীভাবে হয় বা এ সময় কীভাবে সঠিকভাবে যত্ন নিতে হয়। পরিবারে খোলাখুলি আলোচনা হলে এসব বিভ্রান্তি দূর হয়। সবথেকে বড় কথা মেয়েরা কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
-
জরুরি সহায়তার জন্য
পিরিয়ডের সময় যে কোনো মুহূর্তে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজন হতে পারে, কিংবা ব্যথা এতটাই তীব্র হতে পারে যে অবিলম্বে সাহায্য চাওয়া জরুরি হয়। যদি পরিবারের সাথে আগে থেকেই স্বাভাবিকভাবে এসব বিষয়ে কথা বলা থাকে, তবে প্রয়োজনীয় সহায়তা দ্রুত পাওয়া যায়।
পরিবারের সাথে পিরিয়ড নিয়ে কথা না বললে কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে?
পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা পাওয়া এবং নারীদের লজ্জা দেওয়ার সংস্কৃতি এখনো সমাজে এতটাই গভীরভাবে গেঁথে আছে যে, অনেকে মনে করেন এ নিয়ে খোলামেলা কোনো কথা বলা একেবারেই উচিত নয়। পরিবারের সদস্যরাও অনেক সময় সচেতনভাবে এই বিষয়টি এড়িয়ে যান। কোথাও কোথাও মাসিকের সময় মেয়েদের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়, আবার আলাদা করে রাখা হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো অনেক নারী স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসের কথাও খোলাখুলি বলতে পারেন না। তখন তাঁরা ন্যাপকিনের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করে যেটা যথেষ্ট অস্বাস্থ্যকর। বেশিরভাগ মেয়ের জন্য মা ই একমাত্র ভরসার মানুষ, যার কাছে পিরিয়ড নিয়ে কিছু বলা যায়। কিন্তু পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্য এমনকি স্বামীর সাথেও অনেক নারী এই বিষয়ে আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন। অথচ এগুলো খোলাখুলি আলোচনা না করার ফলে মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক দুইই স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।
মেয়েরা পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে চায় না কেন?
মেয়েরা পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে চায় না প্রধানত লজ্জা ও সামাজিক ট্যাবুর কারণে। আমাদের সমাজে পিরিয়ডকে এখনও একটি গোপন বা লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে দেখা হয়, যার ফলে মেয়েরা মনে করে এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বললে তারা লজ্জিত হবেন বা অন্যদের কাছে অস্বস্তিকর মনে হবে। ছোটবেলা থেকেই পিরিয়ড অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা না হওয়ায় অনেকেই এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয় না।
আরও একটি বড় কারণ হলো পরিবারের পুরুষ সদস্য বা সামাজিক পরিবেশে এই বিষয় নিয়ে সচেতনতা ও সহানুভূতি না থাকা। বাবা, ভাই বা সহকর্মীরা যদি সহানুভূতিশীল না হন, তবে মেয়েরা নিজেদের প্রয়োজন বা অস্বস্তি প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে। ফলে তাঁদের মধ্যে সর্বদাই লজ্জা ও সংকোচ কাজ করে।
FAQs
পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা বা সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পরিবার কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিবারের সবাই মিলে পিরিয়ডকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করা। পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব ভাগাভাগি করা, সাহায্যের হাত বাড়ানো এবং খোলামেলা আলোচনা করার মতো সহজ কিছু উদ্যোগ নারীর লজ্জা ও সংকোচ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এ সময় পরিবারের থেকে বড় সহায়তা আর কেউ করতে পারে না। প্রথমে ২/১ জনের সাথে শেয়ার করুন, পরে ধীরে ধীরে অন্যদের সাথেও শেয়ার করবেন।
স্যানিটারি ন্যাপকিন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস চাইতে গিয়ে অনেক মেয়ে কেন দ্বিধা বোধ করে?
অনেক মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস চাইতে গিয়ে দ্বিধা বোধ করে মূলত লজ্জার কারণে। আমাদের সমাজে পিরিয়ডকে এখনও একটি গোপন বা লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে মেয়েরা মনে করে যে এই ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস চাইলে তারা লজ্জিত হবেন বা অন্যদের কাছে অস্বস্তিকর মনে হবে। এছাড়া অনেক পরিবারের মধ্যে পিরিয়ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা না করার রীতি আছে, যা আরও দ্বিধা বাড়ায়। অনেক সময় মেয়েরা মনে করেন, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাছে এ নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়, তাই তারা চুপচাপ নিজের সমস্যার সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করে।
পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাছে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলাটা কেন জরুরি?
এখনও অনেক পুরুষ পিরিয়ড সম্পর্কে খুব কমই জানেন। ছোটবেলা থেকে তাদের কাছে এটি একটি নিষিদ্ধ বা লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়, যার ফলে বড় হয়ে তারা প্রায়শই অসংবেদনশীল আচরণ দেখান। পরিবারে যদি বাবা, ভাই বা স্বামী পিরিয়ড সম্পর্কে সচেতন না হন, তবে নারীরা প্রয়োজনীয় সহায়তা পায় না। কর্মক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। যদি পুরুষ মালিক বা সহকর্মীরা সহানুভূতিশীল না হন, তবে নারী কর্মীরা পিরিয়ডকালীন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। সচেতনতা ও সহানুভূতিশীল মনোভাব থাকলে পরিবার এবং কর্মক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই নারীরা নিরাপদ, স্বস্তি এবং সমর্থনমুখী পরিবেশ পেতে পারেন।
পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা শুরু করতে কাকে বেছে নেওয়া সবচেয়ে ভালো এবং কেন?
পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা শুরু করতে সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি হল সেই মানুষ যার সঙ্গে মেয়েটি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং যার প্রতি বিশ্বাস আছে। সাধারণত মা বা বড় বোনই প্রথম পছন্দ হয়, কারণ তারা নিজেরাও এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন। এরপর ধাপে ধাপে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে এ বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে।
পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনার অভাবে নারীদের আত্মবিশ্বাস কীভাবে প্রভাবিত হয়?
খোলামেলা আলোচনার অভাবে নারীদের আত্মবিশ্বাস অনেকভাবে প্রভাবিত হয়। পিরিয়ডের মতো স্বাভাবিক বিষয়কে লজ্জাজনক বা গোপনীয় বলে ধরা হলে, মেয়েরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যজ্ঞান নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা প্রয়োজনীয় সহায়তা চাইতে বা সমস্যার কথা ভাগ করতে লজ্জা বোধ করে। পরিবারে খোলামেলা আলোচনা থাকলে নারীরা সহজে প্রশ্ন করতে পারে, প্রয়োজনীয় সাহায্য চাইতে পারে এবং নিজের স্বাস্থ্য নিয়েও সচেতন হয়ে ওঠে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বেড়ে যায়।