হঠাৎ পেটে তীব্র যন্ত্রণা হওয়ায় আপনি তড়িঘড়ি ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার আপনার উপসর্গ শুনেই সন্দেহ করলেন যে এটি হয়তো লিভার বা যকৃতের কোনো সমস্যা। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দিলেন এবং সেটি হচ্ছে SGPT পরীক্ষা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রক্তে sgpt বেড়ে গেলে কি হয়। SGPT হলো লিভার কোষের মধ্যে থাকা একটি এনজাইম। যখন লিভার কোষগুলো হেপাটাইটিস, ফ্যাটি লিভার বা অন্য কোনো আঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন এই এনজাইম রক্তপ্রবাহে মুক্ত হয়ে যায়।
রক্তে SGPT এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া তাই যকৃতের অসুস্থতা বা ক্ষতির স্পষ্ট সংকেত দেয়। ধরে নেওয়া যাক, ডাক্তারের পরামর্শ মতো আপনি পরীক্ষাটি করালেন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে রিপোর্টটি খারাপ বা উচ্চ SGPT মাত্রা দেখালো। এখান থেকেই সাধারণ মানুষের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি আসে যদি SGPT টেস্টের রিপোর্ট খারাপ আসে, তবে এই মাত্রা কীভাবে কমানো যাবে? এইসব কিছু নিয়েই আমাদের আজকের এই লেখাটি।
আরও পড়ুনঃ Gintex 500 এর কাজ কিঃ খাওয়ার নিয়ম ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
SGPT পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
অনেক সময় লিভারের সমস্যা বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না। কিন্তু SGPT পরীক্ষা করলে তা আগেভাগেই ধরা পড়ে। ফলে চিকিৎসক সময়মতো ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং গুরুতর জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। হেপাটাইটিস এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে SGPT পরীক্ষা নিয়মিত করলে চিকিৎসার প্রভাব বা উন্নতি বোঝা যায়। এনজাইমের মাত্রা কমে গেলে বোঝা যায় চিকিৎসা কার্যকর হচ্ছে।
SGPT পরীক্ষা কিভাবে করা হয়?
SGPT পরীক্ষা সাধারণত রক্তের নমুনার মাধ্যমে করা হয়। এটি মূলত একটি রুটিন ব্লাড টেস্টের মতোই প্রক্রিয়া। পরীক্ষার জন্য আপনার হাতের শিরা থেকে একটি ছোট সিরিঞ্জ ব্যবহার করে অল্প পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত পরীক্ষার আগে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি প্রয়োজন হয় না, তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক আপনাকে পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে খাবার বা পানীয় এড়াতে বলতে পারেন।
রক্তে কেন SGPT বেড়ে যায়?
রক্তে SGPT বা Serum Glutamate Pyruvate Transaminase মাত্রা বেড়ে যাওয়া মূলত লিভারের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি একটি এনজাইম, যা লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তে নিঃসৃত হয়। ফলে রক্ত পরীক্ষায় SGPT বেশি পাওয়া যায়। এর পেছনে নিম্নলিখিত কারণগুলো থাকতে পারেঃ
- হেপাটাইটিস এ, বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে লিভার কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে SGPT বেড়ে যায়।
- অতিরিক্ত চর্বি জমে লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে SGPT এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- অ্যালকোহল লিভারের কোষ নষ্ট করে, যার কারণে SGPT বাড়তে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদে পেইন কিলার, অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- দীর্ঘদিন লিভারের ক্ষতি চলতে থাকলে সিরোসিস হয় এবং SGPT বাড়ে।
- লিভারের ক্যান্সার বা কোনো টিউমার থাকলেও এটি বাড়তে পারে।
- পিত্তনালীতে পাথর বা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে লিভার কোষে চাপ পড়ে, SGPT বৃদ্ধি পায়।
- এগুলো লিভারের উপর প্রভাব ফেলে, ফলে SGPT বেড়ে যায়।
- শরীরের অন্যান্য গুরুতর সংক্রমণেও লিভার আক্রান্ত হতে পারে, তখন SGPT বৃদ্ধি পায়।
- অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে লিভারের ক্ষতি করে, ফলে SGPT বাড়ে।
রক্তে SGPT বেড়ে গেলে কী কী উপসর্গ দেখা দেয়?
রক্তে SGPT বেড়ে গেলে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এই উপসর্গ গুলো যদি আপনার সাথেও মিলে যায় তাহলে অবশ্যই দেরি না করে পরীক্ষা করানো উচিত। আপনাদের জন্য লক্ষণ বা উপসর্গ গুলো নিচে দিয়ে দিচ্ছিঃ
- খাওয়ার প্রতি অনীহা দেখা দেয়, খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়।
- প্রায়ই বমি বমি ভাব হয়, কখনো কখনো আসলেই বমি হয়।
- বিভিন্ন খাবার থেকে তীব্র দুর্গন্ধ লাগে, খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়।
- সামান্য কাজ বা অল্প আয়াসেই শরীর ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
- সারাদিনই অবসন্নতা ও চরম ক্লান্তি বোধ অনুভূত হয়।
- শরীর সবসময় দুর্বল লাগে, শক্তি ও উদ্যম কমে যায়।
- আলস্য বেশি হয়, কোনো কাজের প্রতিই আগ্রহ জন্মায় না।
- শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, নড়াচড়া করতে মন চায় না।
- শরীর ভারি ও ম্যাজম্যাজে লাগে, মন খিটখিটে হয়ে ওঠে।
- পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌন ইচ্ছা ও সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়।
- পেটের ডান দিকের উপরিভাগে অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভূত হয়।
- শরীরে ভেতর থেকে জ্বালা পোড়া অনুভূত হয়, অস্বস্তি বাড়তে থাকে।
- জ্বর আসে অথবা দীর্ঘসময় জ্বরের মতো অস্বস্তি অনুভূত হয়।
- ত্বকে চুলকানি হয়, বিশেষ করে রাতে সমস্যা বাড়তে পারে।
- হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হয়, চলাফেরায় অসুবিধা তৈরি হয়।
- শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হয়, মাথাব্যথা অবিরত থাকে।
- একই সাথে চোখ ও প্রস্রাবের রঙ হলুদ হয়ে জন্ডিস দেখা দেয়।
রক্তে বেড়ে যাওয়া SGPT এর মাত্রা কমানোর উপায় কী?
রক্তে SGPT মাত্রা বেশি হওয়া মানে লিভারের উপর চাপ হচ্ছে। তাই এটি কমানোর জন্য জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া আরও অনেক করণীয় রয়েছে। নিচে উচ্চ SGPT মাত্রা কমানোর কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলোঃ
-
সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন
যেসব খাবারে অতিরিক্ত তেল, চর্বি, ঝাল ও মসলা থাকে, তা লিভারের জন্য ক্ষতিকর এবং SGPT বাড়িয়ে দেয়। তাই এই ধরনের খাবার পরিহার করে শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, ও আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া উচিত। ভাজা খাবারের পরিবর্তে সিদ্ধ বা ভাপানো খাবার খেলে লিভার হালকা থাকে।
-
অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে পরিহার করুন
মদ্যপান লিভারের কোষের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ফ্যাটি লিভার, লিভার সিরোসিস এবং হেপাটাইটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এগুলো সরাসরি SGPT মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। তাই SGPT মাত্রা কমাতে হলে অ্যালকোহল একেবারে বর্জন করতে হবে।
-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা দিলে SGPT দ্রুত বেড়ে যায়। তাই প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করলে শরীর ফিট থাকে, ওজন নিয়ন্ত্রণে আসে এবং লিভারের কাজ স্বাভাবিক থাকে। নিয়মিত ব্যায়াম রক্তসঞ্চালন উন্নত করে, যা SGPT কমাতে সাহায্য করে।
-
প্রচুর পানি পান করুন
শরীরের টক্সিন বা ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো পর্যাপ্ত পানি পান করা। দিনে ৮ থেকে ১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করলে শরীরের ভেতরের বর্জ্য দ্রুত বের হয়ে যায়, ফলে লিভারের কাজ সহজ হয় এবং SGPT স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে।
-
ওষুধে সেবনে সতর্কতা অবলম্বন করুন
অতিরিক্ত বা দীর্ঘদিন কিছু ওষুধ যেমন পেইন কিলার, অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড এবং কিছু হার্বাল ওষুধ খেলে লিভারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এতে SGPT বেড়ে যেতে পারে। তাই যেকোনো ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং নিজে থেকে ওষুধ শুরু করা ঠিক নয়।
-
হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করুন
হেপাটাইটিস এ ও বি ভাইরাস লিভারের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর কারণগুলোর একটি। এগুলোর কারণে SGPT মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। টিকা গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি সবসময় বিশুদ্ধ পানি পান করা, খাবার পরিষ্কার রাখা এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি।
-
পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক শান্তি বজায় রাখুন
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা মানসিক চাপ লিভারের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। রাত জাগা, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা – এসব কারণে লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় এবং SGPT বেড়ে যেতে পারে। প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো এবং মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করার মাধ্যমে মানসিক শান্তি বজায় রাখা SGPT কমানোর জন্য উপকারী।
-
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
SGPT মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় SGPT বেড়ে গেলেও বাহ্যিকভাবে বড় কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। তাই নিয়মিত ব্লাড টেস্ট করলে সমস্যাটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে এবং সঠিক চিকিৎসা নেওয়া যায়।
Sgpt এর মাত্রা কত থাকলে তাঁকে স্বাভাবিক ধরা হয়?
SGPT পরীক্ষার ফলাফল সাধারণত প্রতি লিটার রক্তের ইউনিটে প্রকাশ করা হয়। ল্যাব রিপোর্টে যে রেফারেন্স ভ্যালু উল্লেখ থাকে, তা থেকেই বোঝা যায় আপনার SGPT মাত্রা স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক। রক্তে যদি SGPT এনজাইম 7 থেকে 56 ইউনিট প্রতি লিটারের মধ্যে থাকে, তবে সেটি স্বাভাবিক ধরা হয় এবং এ নিয়ে সাধারণত কোনো দুশ্চিন্তার কারণ থাকে না।
রক্তে SGPT এর মাত্রা নারী পুরুষ ভেদে কিছুটা পার্থক্য দেখায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে SGPT এর স্বাভাবিক সীমা প্রতি লিটারে ২৯ থেকে ৩৩ ইউনিটের মধ্যে থাকে, অন্যদিকে মহিলাদের জন্য এই মাত্রা সামান্য কম, প্রায় ১৯ থেকে ২৫ ইউনিটের মধ্যে থাকতে পারে।
FAQs
উচ্চ SGPT মাত্রা কি সবসময় মারাত্মক রোগের লক্ষণ, নাকি সাময়িক সমস্যার কারণেও বাড়তে পারে?
উচ্চ SGPT মাত্রা সবসময়ই মারাত্মক রোগের লক্ষণ নয়। অনেক সময় সাময়িক কিছু কারণে SGPT বেড়ে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে SGPT কিছুদিন পর আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে। তবে যদি SGPT মাত্রা দীর্ঘদিন ধরে বেশি থাকে বা এর সাথে জন্ডিস, পেট ব্যথা, খাওয়ায় অরুচি, দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে তা লিভারের গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।
দীর্ঘদিন SGPT বেশি থাকলে শরীরের উপর কী প্রভাব পড়ে?
SGPT দীর্ঘদিন বেশি থাকলে শরীরের উপর নানা ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, কারণ এটি মূলত লিভারের অসুস্থতার লক্ষণ। সবচেয়ে গুরুতর ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিস বা হেপাটাইটিসের মতো মারাত্মক লিভারের রোগ তৈরি হতে পারে, যা জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
রক্তে SGPT কমে গেলে কি হয়?
রক্তে SGPT কমে গেলে সাধারণত তেমন কোনো বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় না। তবে SGPT মাত্রা যদি স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, তাহলে সেটিকে স্বাভাবিক ধরা হয় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই SGPT মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য কম থাকলে চিন্তার কিছু নেই। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুস্থ জীবনযাপন SGPT মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে।