প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেস্টে ব্যথা কেন হয়? জানুন কারণ ও প্রতিকার

গর্ভধারণের সঙ্গে সঙ্গেই নারীর শরীরে নানা ধরণের পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে, যেগুলোর কিছু স্পষ্টভাবে চোখে ধরা পড়ে, আবার কিছু শুধু অনুভূত হয়। এ পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিকভাবে শরীরকে মাতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে। অনেক সময় গর্ভাবস্থার একেবারে শুরুর দিকে স্তনে ব্যথা, টান টান ভাব বা ভারী লাগার মতো অনুভূতি হতে পারে। এটি খুবই সাধারণ একটি লক্ষণ এবং সাধারণত দুশ্চিন্তার কারণ নয়। চাইলে কিছু সহজ ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করে এই অস্বস্তি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। 

আজকের এই লেখায় আমরা ব্রেস্টে ব্যথা হওয়ার কারণ সহ আরও তথ্য শেয়ার করার চেষ্টা করবো। আপনি যদি একজন গর্ভবতী নারী হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার লেখাটি সম্পূর্ণ পড়া উচিত কারণ এখান থেকে আপনি অত্যন্ত জরুরি কিছু তথ্য পেতে চলেছেন। 

আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় খাবারে অরুচি হওয়া স্বাভাবিক কি?

এখানে আপনি পাবেন

প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেস্টে ব্যথা হবার কারণ কী কী?

গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টে ব্যথা বা অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা অনুভব করা একেবারেই স্বাভাবিক এবং এটি অনেক সময় গর্ভধারণের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবেও ধরা হয়। এর মূল কারণ হলো শরীরে দ্রুত ঘটে যাওয়া হরমোনগত পরিবর্তন।

গর্ভাবস্থার শুরুতেই ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ইস্ট্রোজেন স্তনের ভেতরের দুধনালীকে বড় করে তোলে আর প্রোজেস্টেরন দুধ উৎপাদনকারী কোষ বাড়াতে সাহায্য করে। এই পরিবর্তনের কারণে স্তনের টিস্যুতে টান পড়ে এবং ব্যথা বা ভারী লাগার মতো অনুভূতি হয়।

এ সময় স্তনে রক্তপ্রবাহও বেড়ে যায়, যার ফলে স্তন আকারে বড় হতে শুরু করে এবং অনেক নারীর কাছে স্তন স্পর্শে সংবেদনশীল বা ব্যথাযুক্ত মনে হয়। এমনকি স্তনের নিচে থাকা শিরাগুলোও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

গর্ভাবস্থার সঙ্গে সঙ্গে নতুন টিস্যু ও ফ্যাট জমা হতে থাকে, যা স্তনকে টানটান করে এবং অস্বস্তি তৈরি করে। পাশাপাশি, স্তনের বোঁটা ও আশপাশের কালো অংশ আরও সংবেদনশীল হয়ে যায় এবং অনেক সময় সামান্য প্রসারিতও হয়। এসব পরিবর্তনই মূলত ব্রেস্ট পেইনের প্রধান কারণ।

প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেস্টের ব্যথা কমাতে কী কী ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে? 

গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা বা অস্বস্তি কমাতে কিছু সহজ ও ঘরোয়া উপায় মেনে চলা যায়। এগুলো মূলত চাপ কমায় এবং আপনাকে আরাম দেয়। উপায় গুলো নিম্নরূপঃ 

  • আরামদায়ক ব্রা ব্যবহার করা 

সঠিক মাপের, নরম ও সমর্থনশীল ব্রা পড়া গর্ভবস্থায় খুবই উপকারী। মেটারনিটি নার্সিং ব্রা বেছে নিলে বুকের ওজন সমানভাবে ছড়ায় এবং রগ-টিস্যুর ওপর চাপ কমে; ফলে ব্যথা কমতে পারে। ব্রা যেন খুব আঁট না হয়, শুরুতে একটানা হুকের ওপর কমফর্টেবলফিট ধরে রাখুন যাতে বুক বাড়লে সামঞ্জস্য করা যায়।

  • গরম পানির সেঁক দেওয়া  

হালকা গরম ভেজা তোয়ালে বা প্রায় ১০–১৫ মিনিট পর্যন্ত সেক দিন। বিকল্প হিসেবে গরম শাওয়ার করে গরম জলের ঝরনা স্তনের উপর একটু করে দিন। গরম সেঁক রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, দুধনালী খুলে দিতে সাহায্য করে এবং টান কমায়। অতিরিক্ত গরম করবেন না, ব্যবহার করার আগে তাপমাত্রা হাতে চেক করুন।

  • ঠান্ডা সেঁক দেওয়া

আইস প্যাক একটি নরম কাপড়ে মুড়ে ১৫–২০ মিনিট করে ব্যবহার করলে নদভাব, ফুলে ওঠা ও তীব্র অস্বস্তি কমে। বিশেষত দুধ বেশি জমে গেলে ঠান্ডা সেঁক দ্রুত আরাম দেয়। তবে সরাসরি বরফ স্কিনে দেবেন না, কাপড়ে মুড়ে দিন ও ২০ মিনিটের বেশি একবারে দেবেন না।

  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া 

শরীর যত দ্রুত বিশ্রাম পাবে, তত দ্রুত হরমোন ও টিস্যু পুনরুদ্ধার হবে, ফলে স্তনের অস্বস্তিও কমবে। দিনে যতটা সম্ভব ছোট ছোট ঘুম নিন, ভারী কাজ ও অতিরিক্ত উত্তেজনা এড়িয়ে চলুন। পর্যাপ্ত পানি পান করাও জরুরি কারণ হাইড্রেশন টিস্যু সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

  • হালকা মালিশ করা 

অলিভ অয়েল কিংবা নারকেল তেল ব্যবহার করে স্তনে হালকা হাতে ধীরে ধীরে মালিশ করলে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং অস্বস্তি কিছুটা কমে যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মালিশ করার সময় যেন অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া হয়, কারণ এতে উল্টো ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।

  • সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা

শোয়ার সময় কাঁধ ও বুকের সাপোর্টে বালিশ ব্যবহার করুন। বা পাশে ঘুমালে বুকের উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে না। বসার সময়ও হাই ব্যাক সাপোর্ট ব্যবহার করুন; কাঁধ সুস্থভাবে সোজা রাখলে ওপরের পেশির চাপ কমে। 

  • সুষম খাবার খাওয়া

প্রচুর পানি পান রাখুন এবং প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার, আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন। এগুলো টিস্যু মেরামত ও হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রসুতিকালীন ভিটামিন ও মিনারেল নিয়মিত নিন। 

প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেস্টের কোন কোন অংশ জুড়ে ব্যথা হয়? 

Breast And Nipple Pain

গর্ভাবস্থায় স্তনের যেকোনো অংশে, বোঁটা থেকে শুরু করে পুরো স্তনজুড়েব্যথা অনুভূত হওয়া একটি সাধারণ বিষয়। বেশিরভাগ সময়ই উভয় স্তনেই এই পরিবর্তন ঘটে, তবে কখনো কখনো একটি স্তনেও ব্যথা বেশি হতে পারে। ব্যথা কেবল স্তনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে; অনেক সময় এটি বগল, কাঁধ বা এমনকি হাতে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর মূল কারণ হলো গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এবং স্তনে দুধ উৎপাদনের প্রস্তুতি।

এই ব্যথার ধরণ একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। কারও ক্ষেত্রে স্তন স্পর্শ করলে হালকা ব্যথা লাগতে পারে, আবার কারও ক্ষেত্রে সামান্য চাপেই তীব্র ব্যথা শুরু হয়। অনেক সময় ব্রা পরলেই অস্বস্তি বা টান টান ব্যথা অনুভূত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, ব্যথার ধরণ বা তীব্রতা যেমনই হোক না কেন, যদি তা দৈনন্দিন জীবনে বড় কোনো সমস্যা না করে, তাহলে সাধারণত এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। কারণ গর্ভাবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এ ধরনের ব্যথা দেখা দেয়।

প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেস্টের ব্যথা কতদিন থাকে? 

প্রথম তিন মাসের মধ্যে স্তনে ব্যথা বা চাপ চাপ অনুভূতির সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় গর্ভধারণের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহ থেকেই এই অস্বস্তি শুরু হতে পারে। কারও ক্ষেত্রে প্রথম ত্রৈমাসিক শেষে এই ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যায়।

তবে গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে এসে আবারও স্তনে ব্যথা দেখা দিতে পারে, কারণ তখন স্তন শিশুকে দুধপান করানোর জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এ কারণে স্তনের ভেতরে টান টান ভাব, ভারী লাগা বা ব্যথা হওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়।

শিশুর জন্মের পর দুধ খাওয়ানোর সময়ও অনেক মায়েরা স্তনে অস্বস্তি, চাপ বা ব্যথা অনুভব করেন। বিশেষ করে স্তনের বোঁটায় ব্যথা হওয়া অত্যন্ত সাধারণ। তবে এ ধরনের ব্যথা সাধারণত সাময়িক এবং সময়ের সঙ্গে কমে যায়। তাই এটি নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই, কারণ পুরো প্রক্রিয়াটিই স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের অংশ।

ব্রেস্টে ব্যথা কি গর্ভধারনের লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে?

হ্যাঁ, এটিকে গর্ভধারণের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সবসময় এটি  গর্ভধারণের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবেনা কারণ মেয়েদের মাসিকের সময়ও ব্রেস্টে ব্যথা হয়। গর্ভধারনের প্রথম দিকে শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে স্তনে ফুলে ওঠা, টান টান ভাব বা অস্বস্তি দেখা দেয়। এটি সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার হয় এবং প্রথম তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে শুধু ব্রেস্ট পেইনের ভিত্তিতে গর্ভধারণ নিশ্চিত করা যায় না; এটি অন্যান্য লক্ষণ যেমন মিসড পিরিয়ড, বমি ভাব, ক্লান্তি ইত্যাদির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা উচিত। 

FAQs

ব্রেস্টে ব্যথা ও ফুলে ওঠা কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

গর্ভাবস্থায় স্তনে হালকা ব্যথা বা কিছুটা ফুলে ওঠা সাধারণত স্বাভাবিক। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যেমন, যদি ব্যথা খুব তীব্র হয় বা সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে, স্তন লাল হয়ে যায় বা ফোলা বা শক্ত গুটি দেখা দেয়, স্তন থেকে রক্ত বা পুঁজের মতো অস্বাভাবিক তরল বের হয়, অথবা ব্যথার সঙ্গে জ্বর বা সার্বিক অসুস্থতা দেখা দেয়। এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত, কারণ এগুলো স্তনের সংক্রমণ বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

ব্রেস্টে ব্যথা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক তা কীভাবে বোঝা যায়?

গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা সাধারণত স্বাভাবিক, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি অস্বাভাবিক লক্ষণও হতে পারে। স্বাভাবিক ব্যথা সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার হয়। এটি প্রায়ই উভয় স্তনে অনুভূত হয় এবং সময়ের সঙ্গে কমে বা স্থিতিশীল থাকে। অস্বাভাবিক ব্যথার কিছু চিহ্ন হলো ব্যথা খুব তীব্র বা ক্রমবর্ধমান হওয়া। এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে এটি স্বাভাবিক ব্যথা নয় এবং তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

গর্ভাবস্থার পর ব্রেস্টের আকার ও সংবেদনশীলতা কীভাবে পরিবর্তিত হয়?

গর্ভাবস্থার সময় এবং সন্তানের জন্মের পরে স্তনের আকার ও সংবেদনশীলতা অনেকটা পরিবর্তিত হয়। গর্ভধারণের শুরুতেই হরমোনের পরিবর্তনের কারণে স্তন ফুলে যায়, টিস্যু ও দুধনালীর বৃদ্ধি ঘটে এবং স্তন ভারী ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। প্রথম ত্রৈমাসিকে এই পরিবর্তন বেশি লক্ষ্য করা যায়, তবে পুরো গর্ভকাল জুড়েও স্তনের আকার ও সংবেদনশীলতা পরিবর্তিত হতে থাকে।

প্রেগন্যান্সির সময় স্তনের কোন অংশ বেশি সংবেদনশীল হয়?

স্তনের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হলো স্তনের বোঁটা এবং এর চারপাশের কালো অংশ। এই অংশে প্রচুর স্নায়ু শেষাংশ থাকে, যার কারণে এটি স্পর্শ বা চাপের প্রতি খুব সংবেদনশীল হয়। গর্ভাবস্থার সময় এবং শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় এই সংবেদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া স্তনের অন্যান্য অংশেও হালকা টান বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে, কিন্তু বোঁটা ও এরিওলাই সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল থাকে।

গর্ভাবস্থায় ব্রেস্ট থেকে পানি বের হওয়ার কারণ কী?

গর্ভাবস্থায় ব্রেস্ট থেকে পানি বা হালকা সাদা তরল বের হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটি মূলত কলেস্ট্রাম নামে প্রাথমিক দুধের কারণে ঘটে। গর্ভধারণের সময় হরমোন বিশেষ করে প্রোজেস্টেরন এবং প্রোল্যাকটিন স্তনে দুধ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে অনেক নারী স্তন স্পর্শ করলে বা চাপ দিলে হালকা তরল বের হতে পারে। এতে চিন্তার কিছু নেই। 

Author

  • ডাঃ তানহা একজন নিবেদিতপ্রাণ মেডিসিন ও গাইনী বিশেষজ্ঞ, যিনি বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অভ্যন্তরীণ রোগ ও নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তিনি নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য প্রচারে বিশ্বাসী। Emergencypillbd.com-এ তিনি নিয়মিতভাবে প্রেগন্যান্সি, পিরিয়ড, ইমার্জেন্সি পিল এবং নারীস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা শেয়ার করে থাকেন, যা নারীদের সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

Leave a Comment