পিরিয়ড হলো নারীর শরীরে বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু হওয়া একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। সাধারণত প্রতি মাসে নির্দিষ্ট বিরতিতে এটি ঘটে থাকে। পিরিয়ড শুরুর মাধ্যমেই নারীদের প্রজনন ক্ষমতা বিকশিত হয় এবং মাতৃত্ব গ্রহণের স্বাভাবিক যোগ্যতা তৈরি হয়। একজন নারীর পিরিয়ড মূলত তাকে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে। প্রতি মাসে নারীর গর্ভাশয়ে একটি নতুন আবরণ তৈরি হয়, যা গর্ভধারণের পর ভ্রূণকে সুরক্ষা ও আশ্রয় দেওয়ার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। এতো কথা বলার কারণ কি জানেন? আপনার মনে যদি কখনও প্রশ্ন আসে যে প্রতিমাসে পিরিয়ড হওয়া জরুরি কিনা তাহলে তাঁর উত্তর কিছুটা হলেও আশা করি পেয়েছেন।
পিরিয়ড প্রতিটি নারীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া, তাই এটি না হলে অবশ্যই সমস্যা। তাই পিরিয়ড নিয়মিত হচ্ছে কিনা সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কারণ অনিয়মিত পিরিয়ড মানেই শারীরিক সমস্যার সংকেত। আপনারা যারা এই বিষয়ে এখনও অজ্ঞ আছেন তাঁদের জন্য এই লেখাটি একটি তথ্যবহুল আলোচনা হতে চলেছে।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ড অনিয়মিত হলে কি ওষুধ খেতে হবে?
প্রতিমাসে পিরিয়ড হওয়া কি জরুরি?
কিশোর বয়স থেকেই একজন নারীর পিরিয়ড শুরু হয় যেটা একটি নির্ধারিত বয়সসীমা পর্যন্ত চলতে থাকে। আর এই সময়ের মধ্যে নিয়মিত পিরিয়স বা মাসিক হওয়া খুবই জরুরী। সাধারণত কিশোরী বয়সে মাসিক শুরু হলেও এটি প্রথম দিকে কিছুটা অনিয়মিতই থাকে। তবে প্রাপ্ত বয়সে মাসিক অনিয়মিত হওয়াটা কখনোই স্বাভাবিক নয়। প্রতি মাসে কেন পিরিয়ড হওয়া জরুরী তাঁর কয়েকটি কারণ আমরা আপনাদের জানাতে চাইঃ
-
প্রজনন স্বাস্থ্যকে বজায় রাখা
নিয়মিত মাসিক হওয়া মানে শরীরে হরমোনের কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে এবং গর্ভাশয়ও সুস্থ আছে। কিন্তু যদি কারও মাসিক বারবার দেরি হয় বা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এটি শরীরের ভেতরে হরমোনের সমস্যা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতার লক্ষণ হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ডিম্বাণু তৈরি ও গর্ভাশয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে সন্তান ধারণে জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-
হরমোনের সমতা বজায় রাখা
যদি মাসিক অনিয়মিত হয় বা দীর্ঘ সময় না হয়, তবে তা শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দিতে পারে। হরমোনের এই ভারসাম্য শুধু প্রজনন ব্যবস্থার জন্যই নয়, বরং সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যখন মাসিক নির্দিষ্ট সময়ে ও নিয়মিতভাবে হয়, তখন তা প্রমাণ করে যে শরীরে এই হরমোনগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে এবং শরীরের ভেতরের ভারসাম্য ঠিকভাবে বজায় রয়েছে।
-
গর্ভাশয়ের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখা
যদি নিয়মিত মাসিক না হয়, তবে গর্ভাশয়ের অপ্রয়োজনীয় আবরণ ঠিকমতো বের হতে পারে না। ফলে এটি গর্ভাশয়ের ভেতরে জমে থেকে স্ত্রীরোগজনিত জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণে সমস্যা বা আরও গুরুতর গাইনোকলজিক্যাল রোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
-
স্বাস্থ্যগত সমস্যার সতর্কবার্তা
পিরিয়ড যদি নিয়মিত সময়ে না হয় বা বারবার দেরি করে আসে, তবে এটি সাধারণত শরীরের ভেতরে কোনো সমস্যা হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। থাইরয়েড হরমোনের অসামঞ্জস্যও মাসিক চক্রকে ব্যাহত করে। আবার হঠাৎ করে ওজন বেড়ে যাওয়া বা দ্রুত কমে যাওয়াও পিরিয়ডের শিডিউল নষ্ট করতে পারে। শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি না থাকলেও মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
-
মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা
মাসিক অনিয়মিত হলে প্রায়ই নানা ধরনের দুশ্চিন্তা জন্ম নেয়। অনেক সময় মেয়েরা ভাবতে শুরু করে শরীরে কোনো সমস্যা হলো কি না, ভবিষ্যতে সন্তান ধারণে অসুবিধা হবে কি না, কিংবা বড় কোনো রোগ হয়েছে কি না। এসব অনিশ্চয়তা উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে, যা আবার হরমোনের ভারসাম্যকে আরও নষ্ট করতে পারে।
মাসিক নিয়মিত না হলে সমস্যা কী কী?
মাসিক নিয়মিত না হলে শরীরে নানা রকম সমস্যা হতে পারে। তাই রেগুলার মাসিক হওয়ার গুরুত্বক্ব কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। নিয়মিত মাসিক না হওয়ার ফলে এমন কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে।
- অনিয়মিত মাসিকের কারণে ডিম্বস্ফোটন ব্যাহত হয়, ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যেতে পারে।
- শরীরের হরমোন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, যা বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়াকে এলোমেলো করে দেয়।
- ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়, যা হাড় দুর্বল করে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
- জরায়ুর ভেতরের আস্তরণ অস্বাভাবিকভাবে পুরু হতে পারে, দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এবং মেজাজের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
- অনিয়মিত মাসিকের কারণে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
মাসিক নিয়মিত করার জন্য কী করা যেতে পারে?
মাসিক নিয়মিত রাখার জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং মাসিক চক্রকে নিয়মিত রাখতে সহায়ক হয়। পাশাপাশি প্রতিরাতে পর্যাপ্ত ঘুম নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি, কারণ ঘুম হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও মানসিক চাপ কমানোও মাসিক নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে। সুস্থ ওজন বজায় রাখা এবং পর্যাপ্ত পানি পান করাও শরীরের প্রক্রিয়াকে ঠিক রাখে। যদি মাসিক দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মিত হয় এবং এই পদ্ধতি গুলো কাজ না করে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মাসিক না হলে অনেকেই মনে করেন যে ঝামেলা নেই, কিন্তু না এটাকে মোটেও এড়িয়ে যাবেন না কারণ ভবিষ্যতে এটি কোন বড় সমস্যার কারণ হতে পারে।
FAQs
নিয়মিত পিরিয়ড না হওয়ার শারীরিক কারণগুলো কী কী হতে পারে?
নিয়মিত পিরিয়ড না হওয়ার বেশ কিছু শারীরিক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হরমোনের ভারসাম্য না থাকা। এছাড়া শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব, নিয়মিত ঘুম না হওয়া, অত্যধিক মানসিক চাপ ইত্যাদির কারণেও পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। পাশাপাশি যদি শরীরে কোন জটিল অসুখ থাকে যেমন থাইরয়েড সমস্যা বা অন্যকিছু তাহলেও মাসিক অনিয়মিত হতে দেখা যায়।
মাসিক নিয়মিত থাকার মানসিক ও শারীরিক উপকারিতা কী কী?
নিয়মিত পিরিয়ড প্রমাণ করে যে আপনার ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনগুলো সঠিক মাত্রায় কাজ করছে। এই হরমোনগুলো কেবল প্রজনন নয়, বরং সামগ্রিক শারীরিক সুস্থতার জন্যও কাজ করে। মাসিক নিয়মিত হলে একজন নারী তার নিজের শরীর এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও বেশি স্বস্তি ও নিয়ন্ত্রণ অনুভব করেন।
কতদিন পর পর পিরিয়ড হওয়া স্বাভাবিক?
সাধারণত প্রতি মাসে ২১ দিন থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে একবার পিরিয়ড হওয়াই স্বাভাবিক ধরা হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে মাসিক ২১ দিন পরপর হতে পারে, আবার কারও ক্ষেত্রে ২৮ বা ৩০ দিন পরপরও হতে পারে। তবে যদি কারও মাসিক দুই মাস বা তার বেশি সময় না হয়, কিংবা খুব ঘন ঘন হয়, তাহলে সেটা অনিয়মিত হিসেবে ধরা হয়।