আমরা যারা মুসলমান ধর্মে রয়েছি তাঁদের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডেই ইসলামের বিধি-নিষেধের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হয়। আমরা যদি কোন ভুল কাজ করি তাহলে অবশ্যই তাঁর জন্য মহান আল্লাহ পাকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে আমাদেরকে। ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আর এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আলেম বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে থাকেন। আজ আমরা জানবো ইমার্জেন্সি পিল ইসলামে হারাম নাকি হালাল।
ইসলামে পরিবার পরিকল্পনা এবং গর্ভনিরোধক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা রয়েছে। সাধারণত, সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হলেও, কিছু যুক্তিসংগত কারণে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চলুন জেনে নেয়া যাক ইসলামে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহারের ব্যাপারে কি বলা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ইমার্জেন্সি পিল মাসে কতোবার খাওয়া যায়?
ইমার্জেন্সি পিল ইসলামে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল?
সাধারণভাবে সাময়িক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যেমন কনডম বা সাধারণ গর্ভনিরোধক পিল, ইসলামে শর্তসাপেক্ষে অনুমোদিত। ইসলাম বৈধ বিবাহিত দম্পতিকে পারস্পরিক সম্মতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুমতি দিয়েছে, যদি তা কোনো স্থায়ী ক্ষতি না করে। তাই স্বামী-স্ত্রী যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভধারণ বিলম্ব করার উদ্দেশ্যে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহার করেন তাহলে শরিয়তের সীমায় হালাল হতে পারে।
ইমার্জেন্সি পিল সাধারণত ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার আগেই কাজ করে, অর্থাৎ এটি গর্ভপাত ঘটায় না; বরং গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে। যেহেতু এটি এটি গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট করে না সেহেতু, তাহলে ইসলামি ফিকহ মতে এটি হালাল হিসেবে বিবেচিত হয়। তাছাড়া আরও একটি ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি পিল গ্রহণকে ইসলাম বৈধতা দেয়। যদি স্ত্রীর কোনো শারীরিক জটিলতা থাকে এবং চিকিৎসক যদি পরামর্শ দেন যে গর্ভধারণ এই মুহূর্তে বিপজ্জনক, সেক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে পিল ব্যবহার করা শরিয়তসম্মত।
আমাদের সম্মানিত স্কলাররা বলেছেন, আগে যে সন্তানটি হয়েছে তাঁর অধিকার রয়েছে দুই বছর বুকের দুধ পান করার। এই দুই বছরের মধ্যে যদি মা গর্ভধারণ করেন, তাহলে আগের সন্তান অসুস্থ হয়ে যেতে পারে অথবা তাঁর অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কাজেই এক্ষেত্রে জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ইমার্জেন্সি পিল খাওয়া জায়েজ আছে।
মূল কথা হলো, কোন কিছু ব্যবহারে আপনার উদ্দেশ্য যদি সৎ না হয় তাহলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধতা পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহারে বৈধতা অবৈধতা উভয়ই আছে, সেটা নির্ভর করে আপনি কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন তাঁর উপর।
ইমার্জেন্সি পিল ইসলামে কেন হারাম?
ইসলামে ইমার্জেন্সি পিল গ্রহণ করাকে নানা কারণে হারাম বলা হয়েছে। কিছু যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া ইমার্জেন্সি পিল খাওয়াকে হালাল মনে করা হয়না। চলুন কিছু কারণ ব্যাখ্যা সহ জেনে নেয়া যাকঃ
-
ভরণপোষণের চিন্তা
আমি সন্তানদের খাওয়াব কীভাবে, পরাব কীভাবে, এই চিন্তা থেকে যদি কেউ জন্ম নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে সেটি সম্পূর্ণ হারাম কারণ রিজিকের মালিক হলেন আল্লাহ রাব্বুলআলামিন। বিনা কারণে ডিম্বাণুকে তাঁর যথাযথ কাজ করতে বাঁধা দেয়া অন্যায়ের শামিল।
-
শরিয়তের বিপরীত
ইসলামে গর্ভপাত সাধারণত হারাম, যদি না মায়ের জীবন গুরুতর ঝুঁকিতে থাকে বা অন্য কোনো শরীয়তসম্মত ওজর থাকে। যখন নিষেক ঘটে যায়, তখন থেকে একটি সম্ভাব্য জীবনের শুরু হয় বলে বিবেচিত হয়। ইমার্জেন্সি পিল সেই নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হতে না দিয়ে তার বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এক্ষেত্রে এটিতে অনুচিত কাজ বলেই মনে করা হয়। কোন যুক্তিযুক্ত এবং বৈধ কারণ ছাড়া এই কাজ করলে তা কোনোভাবেই হালাল হবেনা।
-
ব্যভিচারে উৎসাহ
কিছু আলেম মনে করেন, ইমার্জেন্সি পিলের সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারের সুযোগ মানুষকে ব্যভিচারের মতো মহাপাপের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যেহেতু এই পিল ব্যবহার করে গর্ভধারণের ভয় কিছুটা দূর করা যায়, তাই এটি ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার একটি নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
-
জীবন বিনাশের সম্ভাবনা
অন্যদিকে যদি কোনো পদ্ধতি সম্ভাব্য জীবনের বিনাশের কারণ হয়, তবে সেটিকে ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোরভাবে দেখা হয়। ইমার্জেন্সি পিলের কিছু কার্যপদ্ধতি সেই জীবন বিনাশের দিকেই ইঙ্গিত করে, যদিও তা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে যদি নারীর শারীরিক কোন সমস্যা থাকে গর্ভধারণে তাহলে পরিস্থিতি বিশেষে এটিকে হালাল হিসেবেই ধরা হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিরোধের প্রচলিত পদ্ধতি কোনটি?
জন্মনিয়ন্ত্রণ মানব সমাজে নতুন কোনো ধারণা নয়। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে এটি চর্চা হয়ে আসছে। তবে আধুনিক সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সমাজজুড়ে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে জন্মনিয়ন্ত্রণের একটি পরিচিত পদ্ধতি ছিল ‘আজল’। এর অর্থ হলো, সহবাসের সময় বীর্য স্ত্রীর যোনির বাইরে স্খলন করা, যাতে গর্ভধারণ এড়ানো যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সরাসরি কোনো নির্দেশ দেননি, আবার সরাসরি নিষেধও করেননি। অর্থাৎ, এ বিষয়ে তাঁর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা আসেনি।
নবী করিম (সা.) বলেন “আমি ইচ্ছা করছিলাম স্তন্যদানকারী নারীদের সঙ্গে সহবাস করতে নিষেধ করি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম রোম ও পারস্যের লোকেরা স্তন্যদায়িনী নারীদের সঙ্গে সহবাস করে, তবুও তাদের সন্তানদের কোনো ক্ষতি হয় না।”
এই বক্তব্যে নবীজির (সা.) দৃষ্টিভঙ্গি খুব সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পেয়েছে যেখানে কোনো পদ্ধতি সরাসরি হারাম ঘোষণা না করেও তার নৈতিক ও মানবিক দিক বিবেচনায় সতর্ক করা হয়েছে।
বর্তমানে বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে যেগুলো সরাসরি হারাম নয় এবং কার্যকারিতাও বেশি। তবে এগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্য সৎ থাকা জরুরী সেটা হোক ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বা স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যে ক্ষেত্রে পিল গ্রহণ না করলেই নয় সেক্ষেত্রে করতে হবে, কিন্তু বারবার গ্রহণ করে গর্ভধারণ রোধ করা উচিৎ নয়। এটা শারীরিক বা মানসিক ভাবে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতেও নেতিবাচক।
FAQ
ইসলামের দৃষ্টিতে কি বিবাহিত দম্পতি প্রয়োজনে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহার করতে পারে?
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহিত দম্পতি প্রয়োজনে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহার করতে পারে কিনা, এই বিষয়টি নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও বেশিরভাগ আধুনিক আলেম সীমিত পরিসরে এর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ‘আজল’ এর প্রচলন ছিল, যা তিনি সরাসরি নিষেধ করেননি। এই হাদিসের আলোকে, অনেক আলেম অন্যান্য সাময়িক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (যেমন সাধারণ গর্ভনিরোধক পিল) স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতিতে এবং শরীয়তসম্মত কারণে ব্যবহারের অনুমতি দেন।
পিল খেয়ে কি জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? ইসলাম কি বলে?
যদি কোনো বিবাহিত দম্পতি উপরে উল্লেখিত শরীয়তসম্মত কারণগুলোর কোনো একটির কারণে সাময়িকভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তবে পিল ব্যবহার করা অধিকাংশ আলেমের মতে জায়েজ। তবে, এটি যেন নিয়মিত সন্তান জন্মদানে অনীহার কারণ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। কেউ যদি প্রতিবার ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কাজটি করে তাহলে ইসলাম এটিকে কখনোই বৈধতা দেয় না।
ইমার্জেন্সি পিলকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ হিসেবে গ্রহণের মূল শর্তগুলো কী?
ইসলামের দৃষ্টিতে এটির বৈধতা পাওয়ার কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যারা এই শর্ত গুলো মেনে ইমার্জেন্সি পিল গ্রহণ করবেন তাঁদের ক্ষেত্রে এটি হারাম হিসেবে গণ্য হবেনা। শর্ত গুলো নিম্নরূপঃ
- স্বামী-স্ত্রীর বৈধ দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে ব্যবহার করা
- স্থায়ী বন্ধ্যাত্বের কারণ যাতে না হয়
- স্বাস্থ্যহানিকর যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা
- জরুরি প্রয়োজনে সীমিত ব্যবহার করা
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করা।