পিরিয়ডের সময় কি খাবারে অরুচি হয়? এর কারণ কী?

পিরিয়ড প্রতিটি নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মাসিক চক্রের এই সময়ে শরীর থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্তের সঙ্গে আয়রনসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান বের হয়ে যায়, যা শরীরকে দুর্বল করে দিতে পারে। অনেক নারীই এ সময় মাথাব্যথা, তলপেট বা কোমরে ব্যথা, বমিভাব, অ্যাসিডিটি বা হজমজনিত সমস্যা যেমন পাতলা পায়খানার মতো অস্বস্তিতে ভোগেন। যারা প্রশ্ন করেন যে পিরিয়ডের সময় কি খাবারে অরুচি হয় কিনা, তাঁদের বলতে চাই যে, হ্যাঁ হয় এবং এটি স্বাভাবিক! 

তাহলে কি না খেয়ে থাকবেন? একদমই না। পিরিয়ড চলাকালীন খাদ্যতালিকায় এমন খাবার রাখা উচিত যা শরীরে শক্তি জোগায়, আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। না হলে পুষ্টির অভাব থেকে দীর্ঘমেয়াদী দুর্বলতা বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এই সময়ে নারীদের বিশেষ যত্নে থাকা এবং খাদ্যাভ্যাসে সচেতনতা বজায় রাখা খুবই জরুরি।

আরও জানুনঃ পিরিয়ড কী, পিরিয়ড কেন হয়, পিরিয়ড কত দিন থাকে? 

পিরিয়ডের সময় খাবারে অরুচি হবার কারণ কী?

পিরিয়ডের সময় খাবারে অরুচি হওয়া একটি পরিচিত ঘটনা। এটি মূলত হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে, তবে অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক কারণও এতে ভূমিকা রাখে। এখানে পিরিয়ডের সময় খাবারে অরুচি হওয়ার প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:

  • হরমোনের পরিবর্তন

মাসিক শুরু হওয়ার ঠিক আগে এবং মাসিকের সময় শরীরে দুই ধরনের হরমোনের মাত্রা দ্রুত কমে যায়। হরমোনের এই আকস্মিক পতনের ফলে ক্ষুধা কমে যেতে পারে।

  • শারীরিক অস্বস্তি 

পিরিয়ডের সময় জরায়ুর সংকোচন হয় যাতে জরায়ুর আস্তরণ শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এর ফলে তলপেটে ব্যথা হয়। তীব্র ব্যথার কারণে অনেক সময় বমি বমি ভাব হতে পারে এবং খাওয়ার আগ্রহ কমে যেতে পারে।

  • বমি ভাব ও বমি

কিছু কিছু নারীর পিরিয়ডের সময় প্রায়ই বমি বমি ভাব হয়, অনেকে বমিও করেন। আসলে কোন কোন নারীর বমির বিষয়টি অতি সংবেদনশীল এবং পিরিয়ডের সময় তা আরও তীব্র হয়। বমি ভাব হতে হতে খাবারের রুচি কমে যেতে থাকে। 

  • হজমের সমস্যা

পিরিয়ডের সময় হজম প্রক্রিয়া অনিয়মিত হতে পারে। এর ফলে বদহজম বা গ্যাস দেখা দিতে পারে। কিছু খাওয়ার সাথে সাথে পেট ফুলে উঠতে পারে। এই ধরনের হজমজনিত অস্বস্তিগুলো স্বাভাবিকভাবেই খাবারের প্রতি অরুচি তৈরি করে।

পিরিয়ডের সময় কোন কোন খাবার খাওয়া উচিৎ?

মাসিক চলাকালীন সময়ে নারীদের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে অনেক আয়রন বের হয়ে যায়, ফলে দেখা দিতে পারে আয়রনের ঘাটতি। এই ঘাটতি পূরণে পুষ্টিকর খাবার বেছে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে পিরিয়ডের সময় সবুজ শাকসবজি খাওয়া দারুণ উপকারী, কারণ এতে থাকে পর্যাপ্ত আয়রন ও অন্যান্য ভিটামিন যা শরীরকে পুনরায় সুস্থ করে তোলে।

প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে ডিম, মাছ বা মাংস গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে। এছাড়াও সপ্তাহে ১/২ বার সামুদ্রিক মাছ খেলে তা আয়রনের পাশাপাশি ফ্যাটি অ্যাসিডের চাহিদাও মেটায়। তবে মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত না খেয়ে পরিমাণে সীমিত রাখা ভালো।

এই সময়ে ফলমূলের মধ্যে রাখতে পারেন পেয়ারা, পাকা পেঁপে, তরমুজ, আমলকি, লেবু, জলপাই, জাম্বুরা, টমেটো, পাকা তেতুল, কালো জাম বা কামরাঙার মতো আয়রন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

পানি খাওয়ার দিকেও বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। দিনে প্রচুর পরিমাণে সাধারণ পানি পান করতে হবে এবং সাথে রাখতে পারেন ঘরে তৈরি ফলের জুস, ভেজিটেবল স্যুপ বা লিকুইড ধরনের খাবার।  যাদের বমি ভাব বা অস্বস্তি হয়, তাদের জন্য সামান্য পরিমাণ আদা দিয়ে তৈরি চা বেশ কার্যকর। তবে সবসময়ই পরিমাণে সতর্ক থাকা উচিত।

যাদের ইউরিনারি ইনফেকশনের প্রবণতা থাকে, তাদের জন্য প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ টকদই এই সময় বেশ উপকারী। এটি হজমে সহায়তা করে এবং শরীরকে ভেতর থেকে সুস্থ রাখে। এই ধরনের খাবার ও পানীয় পিরিয়ডের সময় শরীরকে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে এবং ক্লান্তি দূর করে।

যদি তলপেটে ব্যথা বা অস্বস্তি থাকে, তবে হালকা কুসুম গরম পানি পান করলে আরাম মিলতে পারে। এই সহজ কিছু অভ্যাস পিরিয়ডের সময় শরীরকে চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করে।

পিরিয়ডের সময় কী কী খাওয়া উচিত না? 

which food to avoid

পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত লবণ, তেল মশলা দেওয়া খাবার যেমন সল্টেড বিস্কুট, চিপস ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই ভালো। একইসঙ্গে সফট ড্রিংকস বা যেকোনো কার্বনেটেড পানীয় পুরোপুরি বাদ দেওয়া উচিত। মিষ্টিজাত খাবারও যত কম খাওয়া যায় ততই শরীরের জন্য উপকারী।

এ সময়ে ব্যথা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও ক্লান্তির কারণে অনেকেই ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা বা অবসন্নতা অনুভব করেন। এসব দূর করতে অনেকেই বেশি মাত্রায় চা বা কফি পান করেন। কিন্তু এসব পানীয়তে থাকা ক্যাফেইন শরীরকে পানিশূন্য করে ফেলে এবং আয়রন শোষণে বাধা সৃষ্টি করে, যা শরীরের পুষ্টি ঘাটতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই পিরিয়ডের সময় কয়েকদিন চা-কফি পান থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

FAQs

খাবারে অরুচি হলে কি পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে?

হ্যাঁ, খাবারে অরুচি হলে পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে। যখন একজন ব্যক্তি নিয়মিতভাবে পর্যাপ্ত খাবার খেতে না পারেন বা পুষ্টিকর খাবারের প্রতি অনীহা অনুভব করেন, তখন শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন পায় না। পিরিয়ডের সময় অরুচি হলে যে একদম না খেয়ে থাকবেন বিষয়টা এমন হওয়া উচিৎ নয়। যতটা সম্ভব খাবারের সমতা বজায় রাখতে হবে।  

পিরিয়ডের সময় যদি একেবারেই খেতে ইচ্ছা না করে, তাহলে কী করা উচিত?

পিরিয়ডের সময় যদি একেবারেই খেতে ইচ্ছা না করে, তাহলে এটি খুবই অস্বস্তিকর। এক্ষেত্রে একবারে বেশি না খেয়ে অল্প অল্প করে বারে বারে খান। এটি আপনার পাকস্থলীর ওপর চাপ কমাবে এবং বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া যে খাবারের গন্ধ আপনার অরুচি বাড়ায়, সেগুলো থেকে দূরে থাকুন। পুষ্টিকর খাবার অল্প করে খেতে থাকুন নাহলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। 

প্রতিটি নারীর কি পিরিয়ডে একইভাবে খাবারে অরুচি হয়?

না, প্রতিটি নারীর পিরিয়ডে একইভাবে খাবারে অরুচি হয় না। কেউ কেউ পিরিয়ডের সময় একেবারেই খেতে পারেন না, আবার কেউ শুধু নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি অরুচি অনুভব করেন। কেউ হয়তো স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া-দাওয়া চালিয়ে যেতে পারেন কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই। তাই পিরিয়ডকালীন খাবারে অরুচি হওয়া স্বাভাবিক হলেও এটি সবার ক্ষেত্রে এক রকম নয়। 

পিরিয়ডের সময় অরুচির কারণে অতিরিক্ত ক্লান্তি আসতে পারে কি?

হ্যাঁ, পিরিয়ডের সময় খাবারে অরুচি এবং এর ফলে সৃষ্ট পুষ্টিহীনতা, ডিহাইড্রেশন এবং ঘুমের অভাব অতিরিক্ত ক্লান্তি তৈরি করতে পারে। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে নারীদের শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত ক্ষয় হয়, তা শরীরকে দুর্বল করে তোলে এবং পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি তৈরি করে। এই ঘাটতির ফলে শরীরে দেখা দেয় ক্লান্তি ও দুর্বলতা। 

Author

  • ডাঃ তানহা একজন নিবেদিতপ্রাণ মেডিসিন ও গাইনী বিশেষজ্ঞ, যিনি বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অভ্যন্তরীণ রোগ ও নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তিনি নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য প্রচারে বিশ্বাসী। Emergencypillbd.com-এ তিনি নিয়মিতভাবে প্রেগন্যান্সি, পিরিয়ড, ইমার্জেন্সি পিল এবং নারীস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা শেয়ার করে থাকেন, যা নারীদের সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

Leave a Comment