পিরিয়ডের সময় দুর্বল বোধ করা একটি সাধারণ ব্যাপার। শুধু দুর্বলতা নয়, এ সময় আরও অনেক উপসর্গ শরীর এবং মনে দেখা দেয়। পিরিয়ডের সময় প্রায় সব নারীই কম বেশি দুর্বলতা অনুভব করেন। এছাড়া কেউ কেউ ঘন ঘন মেজাজ হারিয়ে ফেলেন এবং খুব বেশি মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সময়টা পার করেন। এটিকে বলে মুড সুইং। এর পাশাপাশি হজমের সমস্যা, খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া এবং বিভিন্ন শারীরিক অস্বস্তিও দেখা দেয়। আসলে পিরিয়ডের সময় মুড সুইং হওয়ার কারণ কী, আপনারা কি কেউ জানেন? অনেক কারণই থাকতে পারে। তবে এর কারণে নিজেকে অসুস্থ মনে করার কোন দরকার নেই, কারণ আগেই বলেছি যে কম বেশি সব নারীই এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যান মাসিকের দিন গুলোতে।
আমরা নারী স্বাস্থ্য নিয়ে এর আগে বেশ কিছু পোস্ট শেয়ার করেছি। আসলে এমন কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে যেগুলো খুব বেশি জটিল না হলেও আমাদের জানার ঘাটতির কারণে আমরা এগুলোকে জটিল করে ভাবি। তাই আপনাদেরকে সঠিক জিনিস এবং এর সমাধান সম্পর্কে জানানোই আমাদের উদ্দেশ্য। চলুন আজকে জেনে নেয়া যাক যে পিরিয়ডের মুড সুইং কেন হয় বা নারীরা দুর্বলতাই কেন অনুভব করেন এবং এর সমাধান কী।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের সময় পেটে ব্যথা কেন হয়?
পিরিয়ডের সময় মুড সুইং কেন হয়?
পিরিয়ডের সময় নারীদের শরীরে হরমোনের মাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের ওঠানামা মানসিক অবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই হরমোন পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় মেজাজ হঠাৎ ভালো থেকে খারাপ হয়ে যেতে পারে, কেউ হেসে উঠতে পারেন আবার অল্পতেই রেগে যেতে বা দুঃখ পেতে পারেন। এর পাশাপাশি পিরিয়ডজনিত শারীরিক ব্যথা, ক্লান্তি এবং অস্বস্তি মানসিক চাপকে বাড়িয়ে দেয়, যা মুড সুইংকে আরও বেশি তীব্র করে তোলে।
পিরিয়ড শুরুর কয়েকদিন আগে অনেক মেয়ের মধ্যেই মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়, যা খুব দ্রুত রূপ বদলাতে থাকে। এই নির্দিষ্ট সময়ে তারা সহজেই অস্বস্তি, রাগ বা খিটখিটে মেজাজে ভুগতে পারেন, এমনকি অনেক সময় মানসিকভাবে ভেঙেও পড়েন। আসলে নারীর শরীরে থাকা স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা মাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়। একটি পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর ইস্ট্রোজেন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং পরবর্তী পিরিয়ড ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবারও তার ওঠানামা শুরু হয়।
এই হরমোনগত ওঠানামাই মেয়েদের মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলে এবং প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোম (PMS) এর লক্ষণ তৈরি করে। বিশেষ করে সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের মাত্রা কমে গেলে হতাশা, অস্থিরতা বা বিষণ্নতার অনুভূতি বাড়ে। শুধু মানসিক নয়, বরং অনেকের ক্ষেত্রে পিরিয়ড শুরুর আগে শারীরিক লক্ষণও দেখা দেয় যেমন পেটে টান লাগা, খেতে অনীহা, মাথাব্যথা বা শরীরে অস্বস্তি। এসব কারণেই এই সময় মুড সুইং বা মেজাজের ঘন ঘন পরিবর্তন দেখা দেয়।
মুড সুইং কাটানোর উপায় কী?
পিরিয়ডের সময় শরীর ও মন যতটা সম্ভব ভালো রাখতে হবে। এজন্য মুড সুইং এড়ানো জরুরী। মুড সুইং এড়াতে গেলে এমন কিছু কাজ করতে হবে অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে হবে যা আপনার মানসিক অস্থিরতাকে কমিয়ে আনবে। কিভাবে মুড সুইং কাটাবেন তাঁর কিছু উপায় নিচে দেওয়া হলোঃ
-
নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে
এ সময় শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রয়োজন হয়। নিয়মিত খাবার খাওয়ার পাশাপাশি ফল, শাকসবজি ও ভিটামিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। খাবার খাওয়ার ফলে শারীরিক এবং মানসিক উভয়ভাবেই শক্তি বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে মানসিক সক্ষমতা থাকলে মুড সুইং হতে পারবেনা।
-
পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে
ঠিকভাবে ঘুমালে শারীরিক ও মানসিক অসস্তি কমবে। এছাড়া ঘুমের ফলে মস্তিষ্ক যথাসম্ভব স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে। এর ফলে মুড দুইং হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। কেউ কেউ দেখবেন যে পিরিয়ড হওয়া সত্ত্বেও হাসিমুখে এবং ঠাণ্ডা মেজাজে কথা বলে। এর কারণ হচ্ছে তাঁদের ঘুম ও বিশ্রাম পরিমাণ মত হয়েছে।
-
স্ট্রেস কমানো
মুড সুইং কমাতে গেলে স্ট্রেস কমানো জরুরী। যতক্ষণ স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থাকবে। আর মানসিক চাপ থাকলে মুড সুইং হবে ঘন ঘন। তাই স্ট্রেস কমানোর জন্য ভালোভাবে সময় কাটানো, ব্যায়াম করা, পছন্দের কাজগুলো করা, পরিবার ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে গল্প করা – এগুলো করতে হবে। পিরিয়ডের সময় স্ট্রেস কমানোর উপায় সম্পর্কে আমাদের আরও একটি লেখা রয়েছে, সেখান থেকে জেনে নিতে পারেন।
-
হাইড্রেশন বজায় রাখতে হবে
হাইড্রেশন কম থাকলে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি এবং মেজাজের পরিবর্তন আরও তীব্র হয়। ফলে মুড সুইং নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়। যতটা সম্ভব পানি খেতে হবে। পানি খাওয়ার সাথে শরীরের ক্লান্তি দূর হবে এবং মেজাজও ভালো থাকবে। ফলে মুড সুইং অনেকটাই কমে যাবে।
পিরিয়ডের সময় ক্লান্তি বা দুর্বলতার কারণ কী?
পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগের কয়েকদিন থেকেই অনেক মেয়ের মধ্যে ক্লান্তি বা অবসাদ বেড়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রায় সকল নারী মাসিকের আগে ও চলাকালীন সময়ে অস্বাভাবিক দুর্বলতা ও অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করেন। এজন্য এই সময় শরীরকে বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কেন হয় এই দুর্বলতা? জেনে নিনঃ
-
হরমোনের ওঠানামা
পিরিয়ডের আগে ও চলাকালীন সময়ে শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত লাগার একটি প্রধান কারণ হলো হরমোনের পরিবর্তন। এ সময় ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় শরীর শক্তিহীন মনে হয় এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর ধীরে ধীরে যখন ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তখনই ক্লান্তিভাব কমে আসে এবং শরীর স্বাভাবিক শক্তি ফিরে পায়।
-
রক্তক্ষরণ
পিরিয়ডের সময় নিয়মিত রক্তক্ষরণের ফলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি তৈরি হয়।এর ফলেই দুর্বলতা, মাথা ঘোরা এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হয়। তবে রক্তপাত যখন কমে আসে তখন এই দুর্বলতাও কিছুটা কমে আসে, কিন্তু পিরিয়ড শেষ হওয়া পর্যন্ত থেকে যায়।
-
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
অনেক নারী পিরিয়ডের সময় ব্যথা এবং শারীরিক অস্বস্তির কারণে সঠিকভাবে ঘুমাতে পারেন না। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মানসিক চাপ বাড়ে এবং সারাদিন শরীর ক্লান্ত লাগে। যাদের আরও বেশি ব্যথা হয় তাঁরা দিন ও রাত কোন সময়ই ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেন না, ফলে তাঁরা আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়েন।
-
যথাযথ খাদ্য গ্রহণ না করা
পিরিয়ডের সময় শরীরে পুষ্টির চাহিদা বেড়ে যায় কিন্তু অনেকেই এই সময় খাবার খেতে পারেন না ঠিক করে। হজম না হওয়া, গ্যাস হওয়া, বমি বমি ভাব – এসবের কারণে খাবার খেতে পারেন না। পরপর কয়েকদিন ঠিকভাবে খাবার না খেলে শরীর স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে যেতে থাকে।
-
অস্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করা
অনেক নারীর পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে মিষ্টি, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুডের প্রতি আকর্ষণ অনেক বেড়ে যায়। এটি একরকম স্বাভাবিক লোভ মনে হলেও, এই ধরনের খাবার শরীরের জন্য উপকারী নয়। কম পুষ্টিকর ও অতিরিক্ত চিনি বা তেলযুক্ত খাবার খেলে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে, পিরিয়ডের সময় শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি এবং অস্বস্তি আরও বাড়তে পারে।
দুর্বলতা বা ক্লান্তি কাটানোর উপায় কি?
পিরিয়ডের সময় অন্তত কিছুটা দুর্বলতা থাকবেই। তবে এটি বেশি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেকেই পিরিয়ড শুরু হলে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেন এবং সারাদিন শুয়ে বসে থাকেন। এটি কখনোই করা যাবে না। ৩ বেলা খাবার পাশাপাশি কিছু পুষ্টিকর খাবারও খেতে হবে। পেটে গ্যাস হয় এমন খাবার থেকে এ সময় বিরত থাকতে হবে। এছাড়া আপনি যে সারাদিন শুয়ে থাকলেই ব্যথা বা ক্লান্তি কমে যবে বিষয়টা এমন নয়। মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করুন, পারলে সকালে নিয়ম করে কয়দিন ব্যায়াম করুন। এছাড়া যথেষ্ট পানি খেতে হবে। এগুলো করলেই আপনি পিরিয়ডের সময় দুর্বলতা কিছুটা হলেও কাটবে এবং মন ও শরীর ভালো থাকবে।
FAQs
পিরিয়ডের সময় কি সবারই মুড সুইং হয়?
না, পিরিয়ডের সময় সবারই মুড সুইং হয় না। অনেক নারীর ক্ষেত্রে হরমোনের ওঠানামা তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক থাকে, তাই তাদের মুডে বড় পরিবর্তন দেখা যায় না। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে হয় ঠিক এর উল্টোটা হয়। কেউ কেউ এক মুহূর্তে খুশি থাকলেও পরের মুহূর্তেই রেগে যেতে পারেন বা দুঃখিত হয়ে পড়েন। সবাই যে একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যান বিষয়টা এমন নয়।
পিরিয়ডের সময় মুড সুইং কমাতে খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব কতটা?
সঠিক খাদ্যাভ্যাস মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং মন ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন, চকলেট খেলে সাময়িকভাবে ভালো লাগতে পারে, কারণ এটি শরীরে সেরোটোনিন নামক হরমোনের মাত্রা বাড়ায়, যা মেজাজ উন্নত করে। তবে অতিরিক্ত চকলেট খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সব খাবারই সঠিক পরিমাণে ও সঠিক সময়ে খাওয়া জরুরি, যাতে শরীর সুস্থ থাকে এবং মানসিক চাপও কমে।
শারীরিক অস্বস্তি ও ব্যথা কীভাবে মুড সুইং বাড়িয়ে দেয়?
শারীরিক অস্বস্তি ও ব্যথা মেজাজের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, যার ফলে পিরিয়ডের সময় মুড সুইং আরও বাড়তে পারে। এই অস্বস্তি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় এবং কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে মেজাজ খারাপ করে। ব্যথার কারণে নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে মনোযোগ দিতে অসুবিধা অনুভব করেন এবং সহজেই বিরক্ত বা হতাশ হয়ে ওঠেন।
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব পিরিয়ডের সময় দুর্বলতা বাড়ায় কেন?
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব পিরিয়ডের সময় দুর্বলতা বাড়ায়। ফলে পিরিয়ডের সময় ব্যথা, মুড সুইং এবং শক্তি হ্রাসের সমস্যা তীব্র হয়। ঘুমের অভাব ইমিউন সিস্টেমকেও দুর্বল করে তোলে, যার কারণে শরীর সহজেই অবসাদগ্রস্ত ও দুর্বল বোধ করে। ঘুম না হলে মস্তিস্কে অস্থিরতা কাজ করবে এবং ঘন ঘন মুড সুইং করবে।
পিরিয়ডের সময় মুড সুইং হলে কি শারীরিক কোন ক্ষতি হয়?
হ্যাঁ, পিরিয়ডের সময় মুড সুইং শুধু মানসিক নয়, শারীরিক ক্ষতির কারণও হতে পারে। মুড সুইংয়ের ফলে ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে, হজমের গোলমাল হয়, মাইগ্রেন বাড়ে। এছাড়া মেজাজের পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় খাওয়ার প্রতি অনীহা তৈরি হয় বা অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। দীর্ঘ সময় নিয়মিত মুড সুইং হলে এটি স্নায়ুতন্ত্রের ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।