গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কেন হয়? করণীয় কি?

গর্ভাবস্থার শুরুতে বমি বমি ভাব একটি খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক লক্ষণ। বিশেষ করে প্রথম ত্রৈমাসিকে অধিকাংশ নারী এই সমস্যার সম্মুখীন হন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে মেয়েদের বমি ভাব বা মাঝে মাঝে বমি স্বাভাবিক লক্ষণ। এটি মূলত শরীরের হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু বমি মাত্রাতিরিক্ত হলে, যাতে গর্ভবতী মায়ের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে সঠিক চিকিৎসা দরকার। গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কেন হয় তাঁর বিস্তারিত জানতে হলে আপনাকে আমাদের এই লেখাটি পুরো পড়তে হবে। 

গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কেন হয়? 

গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে বিটা এইচসিজি হরমোন বেড়ে যায় বলে বমি ভাব বা বমি হয়। এই সমস্যা সাধারণত সকালে বেশি হয় বলে একে ‘মর্নিং সিকনেস’ বলে। তবে দিনের অন্য সময়ও হতে পারে। এটি স্পষ্ট যে গর্ভাবস্থায় বমি মূলত হরমোনের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন এবং ইস্ট্রোজেনের দ্রুত বৃদ্ধি। 

এই হরমোনগুলি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের উপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে বমি বমি ভাব এবং বমি হয়। গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি,অবসাদ,চাপ বা মানসিক ওঠানামা,যদিও প্রথম তিন মাসের পরে লক্ষণগুলি সাধারণত কমে যায়, কিছু মহিলার গর্ভাবস্থায় সেই সময়ের পরেও বমি বমি ভাব অব্যাহত থাকতে পারে। 

আরও পড়ুনঃ ছেলে সন্তান কত সপ্তাহে হয়: জানুন সম্ভাব্য সময়কাল

গর্ভাবস্থায় কখন থেকে বমি বমি ভাব হতে পারে?

বেশিরভাগ গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব গর্ভধারণের প্রায় ৪ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়। অনেক সময় মাসিক মিস হওয়ার এক বা দুই সপ্তাহ পরেই এই লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। বমি বমি ভাব সাধারণত গর্ভাবস্থার ৮ থেকে ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এই সমস্যা ১২ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকেই কমে আসে বা পুরোপুরি চলে যায়। খুব অল্প সংখ্যক নারীর ক্ষেত্রে এটি পুরো গর্ভাবস্থায় স্থায়ী হতে পারে। তবে সব গর্ভবতী নারীরই বমির সমস্যা দেখা দেয় না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কি শিশুর বিকাশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে?

pregnancy and vomiting

হালকা থেকে মাঝারি বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া সাধারণ এবং সাধারণত শিশুর ক্ষতি করে না। তবে, যদি বমি তীব্র হয় তবে এটি ভ্রূণের বিকাশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত বমি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একটি মজার তথ্য হয়তো অনেকেই জানেন না যে, গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব অনুভবকারী মহিলাদের গর্ভপাতের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এটি সুস্থ গর্ভাবস্থার একটি লক্ষণ হিসেবেও বিবেচিত হয়।

গর্ভাবস্থায় বমি করা কখন গুরুতর হতে পারে?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থার প্রথম তিন-চার মাসের মধ্যে বমি বমি ভাব কমে যায় বা পুরোপুরি চলে যায়। এটি সাধারণত মা বা শিশুর জন্য ক্ষতিকারক নয়। তবে, যদি বমি বমি ভাব বা বমি মাত্রাতিরিক্ত হয়, যার ফলে গর্ভবতী মায়ের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, ওজন কমে যায়, বা পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখন এটিকে হাইপারেমেসিস গ্র্যাভিডারাম বলা হয়। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ এর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

বমি কমাতে কি ওষুধ খাওয়া নিরাপদ?

ঘরোয়া পরামর্শগুলো ঠিকমতো মেনে চলার পরেও বমির সমস্যা না কমলে কিছু ঔষধ খেতে পারেন। গর্ভাবস্থায় বমি ভাব কমানোর জন্য ভিটামিন বি৬ বা পাইরিডক্সিন দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এটি গর্ভাবস্থার বমি ভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। এ সময় অনেকেই একটি ভুল করে থাকেন তা হচ্ছে সাধারণ যেসব বমি কমানোর ঔষধ আছে তাই সেবন করেন। 

আপনার শারীরিক অবস্থা এবং বমির তীব্রতা মূল্যায়ন করে চিকিতসকই সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর সমাধানের পরামর্শ দেবেন। নিজে নিজে কোনো ওষুধ কিনবেন না বা সেবন করবেন না। তবে যেহেতু এ সময় বমি একটি স্বাভাবিক অবস্থা সেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তার কোন কারণ নেই। 

বমি বমি ভাব কমানোর ঘরোয়া উপায় কী কী?

মনে রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায় বমি হরমোনের প্রভাবে হয় বলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা পুরোপুরি সারানো সম্ভব নয়। অতিরিক্ত তেল-চর্বি, ঝাল, গুঁড়া মরিচ, গুঁড়া মসলা, পুরোনো আচার, ভাজাপোড়া ইত্যাদি খাবার পরিহার করতে হবে। যেসব খাবার খেলে বমি হয়, সেগুলো বাদ দিতে হবে। 

 

পর্যাপ্ত পানি, আমিষ ও ভিটামিন ‘বি’সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।সকালে সমস্যা বেশি হয়, তাই সকালে দাঁত ব্রাশ না করে রাতে বা দুপুরে করা যেতে পারে। সকালে শুকনা খাবার যেমন টোস্ট বিস্কুট, মুড়ি ইত্যাদি খেতে হবে। একবারে ভরপেট না খেয়ে অল্প অল্প করে ১-২ ঘণ্টা পরপর খেতে হবে।

খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি পান না করে কিছু সময় পর পান করতে হবে। খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শোয়া যাবে না। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ সোজা হয়ে বসে থাকলে বা হালকা হাঁটাহাঁটি করলে ভালো। আদা বমি ভাব বা বমি কমাতে খুব উপকারী। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।

বমির অন্যান্য কারণ যেমন পেটের আলসার, থাইরয়েডের রোগ, প্রস্রাবের সংক্রমণ, প্যানক্রিয়াসে প্রদাহ, পিত্তথলিতে প্রদাহ বা পাথর, অ্যাপেন্ডিসাইটিস ইত্যাদি কারণ নির্ণয় হলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

FAQs

গর্ভকালীন বমি কি প্রতিদিন হওয়া স্বাভাবিক?

হ্যাঁ, গর্ভকালীন বমি বা বমি বমি ভাব প্রতিদিন হওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। বিশেষ করে ১ম থেকে ১২তম সপ্তাহ এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অনেক নারী প্রতিদিনই সকালে বা দিনে কয়েকবার বমি বা বমি বমি ভাব অনুভব করেন। তবে এই লক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কেউ দিনে একবার বমি করে, কেউ আবার কয়েকবার; কারও ক্ষেত্রে শুধু বমি বমি ভাব হয়, আবার কারও একেবারেই হয় না। এটি গর্ভধারণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়।  

শুধু সকালেই কেন বমি বমি ভাব বেশি হয়?

গর্ভাবস্থায় সকালে বমি বমি ভাব বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হলো খালি পেট থাকা এবং রাত্রিকালীন দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে পাকস্থলীতে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পাকস্থলী ফাঁকা থাকে এবং তখন হরমোনজনিত প্রভাব এর মাত্রা উচ্চ থাকায়, বমি বা বমি বমি ভাব বেশি অনুভূত হয়। যদিও এটি শুধু সকালে হয় এমন নয় অনেক নারীর দুপুর, সন্ধ্যা বা রাতেও একই সমস্যা হতে পারে। তবে খালি পেটে থাকলে এই উপসর্গ সাধারণত আরও তীব্র হয়। এজন্য সাধারণত সকালের দিকেই বমি তীব্রতা লক্ষ্য করা যায়। 

লেবু বা আদা কি বমি কমাতে সাহায্য করে?

হ্যাঁ, লেবু এবং আদা উভয়ই গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং সাধারণত এগুলো নিরাপদ প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। লেবুর সতেজ গন্ধ বমি বমি ভাব কমাতে খুবই কার্যকর। অনেকেই লেবুর খোসার গন্ধ শুঁকে বা একটি তাজা লেবুর স্লাইস নাকের কাছে ধরে রাখলে আরাম পান। সকালে ঘুম থেকে উঠে বা দিনের যেকোনো সময় হালকা গরম বা ঠান্ডা জলে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে বমি বমি ভাব কমতে পারে। 

Author

  • ডাঃ তানহা একজন নিবেদিতপ্রাণ মেডিসিন ও গাইনী বিশেষজ্ঞ, যিনি বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অভ্যন্তরীণ রোগ ও নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তিনি নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য প্রচারে বিশ্বাসী। Emergencypillbd.com-এ তিনি নিয়মিতভাবে প্রেগন্যান্সি, পিরিয়ড, ইমার্জেন্সি পিল এবং নারীস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা শেয়ার করে থাকেন, যা নারীদের সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

Leave a Comment