বাচ্চা নেয়ার আগে কিভাবে প্রস্তুতি নেবো? কী করবো এবং কী করবো না?

অনেক নারী বা পুরুষের মনে প্রশ্ন থাকে যে বাচ্চা নেয়ার আগে কোন প্রস্তুতি নেয়া উচিৎ কিনা বা বাচ্চা নেয়ার আগে কিভাবে প্রস্তুতি নেবো ইত্যাদি। আসলে সুস্থ মা ও সুস্থ শিশুর জন্য একটি সচেতন, পরিকল্পিত গর্ভধারণ অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি দম্পতির উচিত সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বিষয়টি সুপরিকল্পিতভাবে বিবেচনা করা এবং একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। 

গর্ভধারণ শুধু একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি মা ও শিশুর উভয়ের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তাই এই সময় থেকে শুরু করে গর্ভকালীন সময় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যত্ন ও প্রস্তুতির প্রয়োজন থাকে, যা দম্পতিরা শুরু থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিলে ভবিষ্যতে অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়।

আরও পড়ুনঃ প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ মানে কি?

বাচ্চা নেয়ার আগে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়? 

বাচ্চা নেওয়ার আগে একজন দম্পতির কিছু শারীরিক, মানসিক ও জীবনধারাগত প্রস্তুতি নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তুতির উপর ভবিষ্যতের অনেক কিছু নির্ভর করে। কি কি প্রস্তুতি নিতে হবে তা জেনে নিনঃ 

  • নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা

গর্ভধারণের আগে থেকেই প্রতিদিন একটি নির্ধারিত পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিৎ। নিয়মিত ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করার ফলে শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে গঠিত হয়।  এটি গর্ভের প্রথম কয়েক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়, তাই গর্ভধারণের আগেই শুরু করাই ভালো।

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে 

অতিরিক্ত ওজন বা খুব কম ওজন— উভয়ই গর্ভধারণে সমস্যা তৈরি করতে পারে। ওজন ঠিক না থাকলে ওভুলেশন বাধাগ্রস্ত হয়, এমনকি গর্ভাবস্থায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই সঠিক ওজন বজায় রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে শরীরের মোটামুটি ধরনের ওজন হলেই যথেষ্ট। 

  • সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন 

সন্তান নেওয়ার আগে থেকেই স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা জরুরি। নিয়মিত সবুজ শাকসবজি, দুধ, ডিম, মাছ, বাদাম, ফলমূল গ্রহণ করতে হবে কারণ এগুলো গর্ভধারণের জন্য জরুরি পুষ্টি সরবরাহ করে। নারী পুরুষ উভয়েরই খাবারের ব্যাপারে সচেতন থাকা দরকার বলে আমরা মনে করি। 

  • মানসিক প্রস্তুতি

একজন নারী ও পুরুষ উভয়েরই মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়ে দম্পতির খোলামেলা আলাপ করা উচিত। কতদিন পর সন্তান নিতে চান বা কখন সন্তান নেয়া উচিৎ এ ব্যাপারে উভয়েরই মতামত গুরুত্বপূর্ণ। দুজনই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই সন্তান নেয়া উচিৎ। 

  • অভ্যাসগত পরিবর্তন আনতে হবে 

কজন নারী যখন সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন, তখন শুধুমাত্র শারীরিক প্রস্তুতি নয়, বরং জীবনযাপনের ধরণেও প্রয়োজন হয় ইতিবাচক পরিবর্তনের। ধূমপান নারীদের ডিম্বাণুর গুণগত মান নষ্ট করে এবং গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। তাই এসব ক্ষতিকর অভ্যাস যদি আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাহলে শরীর গর্ভধারণের উপযোগী হয় এবং ভবিষ্যতের শিশুও সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে। 

  • আর্থিক পরিকল্পনা

সন্তান আসার পর খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তাই আগেভাগেই একটি বাজেট পরিকল্পনা করে রাখা ভালো। পরিকল্পনা করে না রাখলে অনেকেই সন্তান আসার পর খরচ মেটাতে হিমশিম খান। যদি সন্তান নেওয়ারই পরিকল্পনা থাকে তাহলে খরচ সাশ্রয় করতে হবে। 

  • বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে 

সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্তের পরই একজন গাইনী চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। বা তার আগেও চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা ভালো কারণ অনেকেই সন্তান নিতে না চেয়ে ক্রমাগত পিল খেতে থাকেন, এতে পরবর্তীতে সন্তান ধারন করতে গেলে সমস্যা হয়। এজন্য সন্তান নেবার ইচ্ছা থাকলে বেশ আগে থেকে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। 

গর্ভধারণের আগে কি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিৎ? 

pre-conception checkup

হ্যাঁ, গর্ভধারণের আগে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কখনো কখনো রক্তস্বল্পতা, থাইরয়েড, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্যান্য রোগ গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এই সব শারীরিক অবস্থা আগে থেকেই চিহ্নিত করতে পারলে সময়মত চিকিৎসা নেওয়া যায়।

এছাড়া অতিরিক্ত বা কম ওজন উভয়ই গর্ভধারণে সমস্যা করতে পারে। তাই আপনার ওজন কোন পর্যায়ে আছে সেটা জেনে নেয়া ভালো। ওজন বেশি হলে কমাতে হবে আর একদম কম হলে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করতে হবে। 

কিছু নির্দিষ্ট রোগ দম্পতির উভয়ের মধ্যে থাকলে শিশুর মধ্যে তা দেখা দিতে পারে। এই ধরনের রোগের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের আগেই চিকিৎসা নেয়া ভালো যেন শিশু পর্যন্ত তা না পৌঁছায়। 

একইসাথে জরায়ুর কোনো সমস্যা আছে কিনা তা সাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে। জরায়ুর কোন গুরুতর সমস্যা সন্তান ধারনে বাঁধা দিতে পারে। মোটকথা, যদি আপনি সন্তান ধারন করতে চান তাহলে সাস্থ্যের ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হতে হবে কারণ আপনার সাস্থ্যের সাথে আপনার বাচ্চার সাস্থ্য জড়িত।  

বাচ্চা নেওয়ার আগে পুরুষের করনীয় কী?

সুস্থ শিশুর জন্য সুস্থ মা ও বাবা দুজনই প্রয়োজন। তাই মায়ের পাশাপাশি একজন বাবাকেও বেশ কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। অনেক পুরুষ ধূমপান করেন। জেনে রাখা ভালো যে, ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান শুক্রাণুর সংখ্যা, গতিশীলতা এবং ডিএনএ এর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই এগুলো থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। নিয়মিত হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম করা ভালো, এটি শুক্রাণুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে অতিরিক্ত তীব্র ব্যায়াম শুক্রাণুর উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে। 

এছাড়া অণ্ডকোষের তাপমাত্রা শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম থাকা প্রয়োজন। তাই দীর্ঘক্ষণ গরম পানিতে গোসল করা, বা টাইট অন্তর্বাস পরা এড়িয়ে চলুন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে টাইট অন্তর্বাস পরা পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা অনেকাংশেই কমে যায়। 

FAQs

গর্ভধারণের আগে কী ধরনের খাদ্যতালিকা অনুসরণ করা উচিত?

গর্ভধারণের আগে নারীর উচিত এমন সব খাবার গ্রহণ করা যাতে পর্যাপ্ত আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন থাকে। এই সময় বেশি তেলমসলা, সফট ড্রিংকস বা প্রিজারভেটিভযুক্ত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। পাশাপাশি, পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে যাতে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় থাকে। যদি গর্ভধারণের আগে থেকেই এই ধরনের স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা মেনে চলেন, তাহলে আপনার শরীর গর্ভধারণের জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হবে। 

স্বামী স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সন্তান নেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা কিভাবে বোঝা যায়?

স্বামী ও স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত কিনা, তা বোঝার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে উভয়ের দেহে কোনো জেনেটিক সমস্যা, হরমোন ভারসাম্যহীনতা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ রয়েছে কি না, তা জানা যায়। স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রজনন অঙ্গের স্বাভাবিকতা এবং মাসিক চক্র নিয়মিত আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ জরুরি। 

অন্যদিকে, স্বামীর ক্ষেত্রে স্পার্ম কাউন্ট ও গতিশীলতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এছাড়া ওজন, ডায়েট, ঘুমের অভ্যাস এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাও পরীক্ষা করা হয়। এসবকিছু ঠিক থাকলেই ধরে নেয়া যেতে পারে যে আপনারা দুজনই সন্তান নেওয়ার জন্য একদম ফিট। 

Author

  • ডাঃ তানহা একজন নিবেদিতপ্রাণ মেডিসিন ও গাইনী বিশেষজ্ঞ, যিনি বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অভ্যন্তরীণ রোগ ও নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তিনি নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য প্রচারে বিশ্বাসী। Emergencypillbd.com-এ তিনি নিয়মিতভাবে প্রেগন্যান্সি, পিরিয়ড, ইমার্জেন্সি পিল এবং নারীস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা শেয়ার করে থাকেন, যা নারীদের সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

Leave a Comment