পিরিয়ড নিয়মিত হওয়াটাই স্বাভাবিক, প্রতি মাসে নির্ধারিত সময়ে পিরিয়ড হলে সেটাকে নিয়মিত পিরিয়ড বলা হয়। যদি এক বা একাধিকবার পিরিয়ডের সময় বেশি এগিয়ে আ সে বা বেশিদিন পিছিয়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে এটিকে অনিয়মিত পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এই পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার কারণ কী? পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়া অবশ্যই কোন শারীরিক জটিলতার ইঙ্গিত। তাই যদি একাধিকবার এমন হয় তাহলে এ বিষয়ে ভাবা উচিৎ।
আজকের আর্টিকেল এ আমরা অনিয়মিত পিরিয়ড কেন হয় সে সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরবো। এছাড়া অনিয়মিত পিরিয়ড হলে কী করবেন সে সম্পর্কেও পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করবো। অনুরোধ থাকবে আমার এই লেখাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মন দিয়ে পড়ার।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের সময় কি খাবারে অরুচি হয়?
অনিয়মিত পিরিয়ড কি?
অনিয়মিত পিরিয়ড বলতে এমন মাসিক চক্রকে বোঝায় যেখানে রক্তপাতের পরিমাণ বা স্থায়ীত্ব প্রতিবার একরকম থাকে না। কখনো পিরিয়ড আগেই শুরু হয়, কখনো দেরি হয়, কখনো ১ মাস বাদ পড়ে যায়। এমনকি রক্তপাত অস্বাভাবিকভাবে কম বা বেশি হয়। এসব লক্ষণের কোন একটি বারবার ঘটলে তাকেই অনিয়মিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনিয়মিত পিরিয়ড হওয়া মোটেও ভালো নয়। শরীরে কোন রোগ বা জটিলতা থাকলেই পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তাই এমনটা হলে চুপচাপ বসে না থেকে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে হবে।
অনিয়মিত পিরিয়ড কেন হয়?
পিরিয়ড বা মাসিক অনিয়মিত হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এই কারণ গুলো সম্পর্কে সকলেরই জেনে রাখা উচিৎ। এর মধ্যে বেশিরভাগ কারণ আপনারা চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারেন এবং মাসিকের এই অনিয়মিততা দূর করতে পারেন। চলুন কারণ গুলো দেখে নেয়া যাকঃ
-
মানসিক উদ্বেগ
দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশকে প্রভাবিত করে যা সাধারণত হরমোন নিঃসরণ করে। এর ফলে পিরিয়ডে বিলম্ব হয়। অনেকেই আছে যারা পরীক্ষার টেনশন, সম্পর্কজনিত সমস্যা বা চাকরির দুশ্চিন্তা করতে থাকেন। এসব টেনশনের কারণে মাসিক যথাসময়ে হয় না অনেক সময়।
-
অতিরিক্ত ব্যায়াম করা
অতিরিক্ত পরিশ্রমমূলক ব্যায়াম, যেমন প্রতিদিন দীর্ঘসময় ধরে জিমে অনুশীলন করা, দৌড়ানো বা প্রশিক্ষণ শরীরে শক্তির ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। যখন শরীর প্রয়োজনীয় পরিমাণ শক্তি পায় না, তখন তা হরমোন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে কমিয়ে দেয়। এর ফলে মাসিক চক্র ব্যাহত হয় বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
-
ওজন খুব বেশি বা কম
শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমলে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা পিরিয়ডের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে, অতিরিক্ত রুগ্ণতা বা পর্যাপ্ত খাবার না খাওয়ার ফলে শরীর প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এর ফলে ডিম্বাণু তৈরি ব্যাহত হয় এবং মাসিক অনিয়মিত হতে পারে বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
-
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
নারীদের মাসিক চক্র সঠিকভাবে পরিচালিত করতে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই দুটি হরমোনের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কমে বা বাড়ে, তাহলে শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়। ফলে মাসিক কখনো নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হতে পারে, কখনো দেরিতে হয় কিংবা কিছু মাস একেবারেই বন্ধ থাকতে পারে।
-
থাইরয়েড সমস্যা
থাইরয়েড এর সমস্যাও মাসিককে অনিয়মিত করে দেয়। কম সক্রিয় থাইরয়েড এর কারণে পিরিয়ড ভারি ও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। অপর দিকে অতিরিক্ত সক্রিয় থাইরয়েড মাসিককে হালকা বা অনিয়মিত করে দেয়। তাই থাইরয়েডের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে তাঁর প্রভাব পড়ে মাসিক চক্রের উপর।
-
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খেলে অনেকসময় মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কোন কোন নারী ইনজেকশন বা ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করেন, এর ফলে মাসিক এর বিরতি অনেক দীর্ঘ হয় বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হবার আশংকা থাকে।
-
বয়সভিত্তিক হরমোনের পরিবর্তন
কিশোরী বয়সে মাসিক শুরু হওয়ার পর প্রথম কয়েক বছর শরীরের হরমোন ব্যবস্থা পুরোপুরি স্থির না হওয়ায় পিরিয়ড নিয়মিত নাও হতে পারে। অন্যদিকে, মেনোপজের আগের সময়টিতে শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক ভারসাম্য ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। এর ফলে মাসিক কখনো সময়ের আগে, কখনো দেরিতে হতে পারে বা কিছু সময়ের জন্য বন্ধও থাকতে পারে।
অনিয়মিত মাসিক হলে কী কী সমস্যা হয়?

মাসিক যাদের অনিয়মিত হয় তাঁদের শরীরে ধীরে ধীরে নানা সমস্যা বাসা বাঁধতে থাকে। মূলত সমস্যা থাকে বলেই পিরিয়ডের এই অনিয়মিত অবস্থা। জেনে নিন পিরিয়ড বন্ধ থাকলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারেঃ
- গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
- শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ঘটে।
- অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।
- মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা বৃদ্ধি পায়।
- পেটে ব্যথা ও শারীরিক অস্বস্তি দেখা দেয়।
- জরায়ুতে সংক্রমণ হতে পারে এবং জরায়ুর ক্যান্সারের মত জটিল রোগও হয়।
পিরিয়ড না হলে কি কোন ঘরোয়া উপায় রয়েছে?
হঠাৎ করে মাসিক বন্ধ হলে চিন্তার কিছু নেই, কিছু ঘরোয়া উপায় প্রয়োগ করলে অনেকাংশেই এটি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। এমন কিছু খাবার আছে যা খেয়ে অনেকেই ভালো ফল পেয়েছেন এবং আশা করা যায় আপনিও পাবেন। এমনটা অনেকসময় হতেই পারে যে নিয়মিত মাসিক হতে হতে এক বা দুই মাস একটু অনিয়মিত হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারেন।
- টকজাতীয় ফল যেমন তেঁতুল, মাল্টা বা জলপাই প্রাকৃতিকভাবে হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- আদাও মাসিক চক্র নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে। এক কাপ পানিতে আধা চা চামচ কুচানো আদা দিয়ে ৫ থেকে ৭ মিনিট ফুটিয়ে নিয়ে দিনে তিনবার খাবারের পর তা পান করা যেতে পারে। নিয়মিত এক মাস খেলে উপকার পাওয়া যায়।
- তিল শরীরের হরমোন উৎপাদনে সহায়ক একটি উপাদান হিসেবে কাজ করে। অল্প তিল ভেজে গুঁড়ো করে এক চা চামচ গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খালি পেটে প্রতিদিন সকালে খেলে অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিত হতে পারে।
- এ ছাড়াও আপেল সাইডার ভিনেগার ইনসুলিন এবং রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণ করে হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন খাবার খাওয়ার আগে ১ গ্লাস পানিতে ২ টেবিল চামচ আপেল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে পান করা যেতে পারে।
আপনাকে মনে রাখতে হবে যে সব অবস্থায় পিরিয়ড বন্ধ হওয়া বা অনিয়মিত হওয়ার কারণে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিছু ঘরোয়া উপায় আপনাকে পিরিয়ড নিয়মিত করতে সাহায্য করবে।
FAQs
কখন পিরিয়ড অনিয়মিত ধরা হয়?
যদি প্রতি মাসে পিরিয়ডের সময় একেক রকম হয় তাহলে অবশ্যই এটি অনিয়মিত পিরিয়ড! এছাড়া মাসিক চক্রটি যদি ২১ দিনের কম বা ৩৫ দিনের বেশি হয় বা এক মাস পিরিয়ড হলো, পরের মাসে হলো না তাহলে এটিও অনিয়মিত মাসিকের আওতায় পড়ে। অনেকের মাসে দুইবার পিরিয়ড হয়ে যায় এবং কারো কারো রক্তপাত খুব বেশি বা খুব কম হয়। এই সবকিছুই অনিয়মিত মাসিক।
অনিয়মিত মাসিক হলে কি বাচ্চা হয়?
অনিয়মিত মাসিকের কারণে গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে কারণ পিরিয়ডের অনিয়ম মানে ডিম্বাণুর সঠিক সময়ে নির্গত হয়না বা ওভুলেশন ঠিকমত হয়না। তবে গর্ভধারণ অসম্ভব বলা যাবে না। সঠিক জীবনধারা এবং সময়মত চিকিৎসা করা হলে অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কিশোরীদের মাসিক অনিয়মিত হওয়া কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, কারণ কিশোরী বয়সে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য সেভাবে তৈরি হয়না। এজন্য পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত পিরিয়ড অনিয়মিত থাকে। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ঠিক হলে পিরিয়ডও নিয়মিত হয়ে যায়। তবে প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়া চিন্তা বিষয় হতে পারে।