মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাব সাধারণত প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে হয়ে থাকে। মাসিক শুরুর আগে অনেকেরই পেটে ব্যথা হয়, যা পিরিয়ড চলাকালীন সময় প্রায় অবিরত থাকতে পারে। বিশেষ করে তলপেটের ব্যথা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। খুব অল্পসংখ্যক নারীই আছেন, যারা জীবনে একবারও এই ব্যথা অনুভব করেনি। কিন্তু আপনি কি জানেন পিরিয়ডের সময় পেটে ব্যথা কেন হয়? আর এই ব্যথা কতটুকু হলে তাঁকে স্বাভাবিক ধরা হয় বা কখন ডাক্তার দেখানো উচিৎ – এইসব প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়।
প্রায় সব নারীই প্রতি মাসে পিরিয়ডের সময় ব্যথা অনুভব করেন। এ সময় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে ব্যথা অনেক সময় অসহ্য মনে হয়। অনেক সময় নানা ধরনের ওষুধ সেবন করলেও এই ব্যথা পুরোপুরি কমানো যায় না। তাই ব্যথার পরিমাণ যাচাই করে তারপর কোন চিকিৎসা নিতে হবে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার কারণ কী?
পিরিয়ডের সময় পেটে ব্যথা হওয়ার কারণ কী?
পিরিয়ডের সময় পেটে ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি। মাসিক শুরুর সময় শরীরে এই হরমোন বেশি তৈরি হয়, যা জরায়ুর পেশিকে সঙ্কুচিত করে পুরনো রক্ত ও টিস্যু বের করতে সাহায্য করে। এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই পেট ব্যথা হয়।
রক্তনালীর সংকোচনও পেটে ব্যথার বড় একটি কারণ। জরায়ুর পেশি সঙ্কোচনের সময় আশপাশের রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয়। এতে টিস্যুতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, যা ব্যথার অনুভূতি বাড়ায়।
এছাড়া, প্রতি মাসে জরায়ু গর্ভধারণের জন্য একটি আস্তরণ তৈরি করে, যা গর্ভধারণ না হলে মাসিকের মাধ্যমে ঝরে পড়ে। এই ঝরে পড়া আস্তরণকে বের করে দেওয়ার সময় পেশি সঙ্কুচিত হয়, যা কিছু নারীদের ক্ষেত্রে খুব ব্যথাদায়ক হয়।
কখন পিরিয়ডের ব্যথা চিন্তার কারণ হতে পারে?
সাধারণ পিরিয়ড ব্যথা সাধারণত অসহনীয় হয় না এবং ব্যথানাশক ওষুধ বা গরম সেঁক দিলে কমে যায়। যদি ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে আপনি দৈনন্দিন কাজ করতে না পারেন, বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয় বা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় তাহলে অবশ্যই এটি চিন্তার কারণ। অনেকের দেখা যায় যে পিরিয়ড শুরু হওয়ার বেশ কয়েক দিন আগে থেকে ব্যথা শুরু হয় এবং পিরিয়ড শেষ হওয়ার পরেও ব্যথা থেকে যায়। এটি নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক ব্যথার চেয়ে কিছু বেশি। এছাড়া ব্যথার সাথে যদি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি রক্তপাত হয় তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায়ঃ
এমন কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে যেগুলো প্রয়োগ করলে পিরিয়ডের সময় হওয়া পেট ব্যথা কিছুটা হলেও উপশম হতে পারে। ওষুধ খাওয়ার থেকে এই ধরনের ঘরোয়া উপায় অত্যন্ত কার্যকরী এবং নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়। চলুন ঘরোয়া উপায় গুলো দেখে নেয়া যাকঃ
-
গরম পানির সেক
পিরিয়ডের সময় ব্যথা উপশমের একটি সহজ ও কার্যকর উপায় হলো গরম পানির সেক দেওয়া। গরম সেক দেওয়ার ফলে পেটের পেশি শিথিল হয় এবং প্রদাহ কমে যায়, যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তাই মাসিকের সময় তলপেটে হালকা করে গরম পানির সেক নিলে অল্প সময়ের মধ্যেই আরাম পাওয়া যায় এবং অস্বস্তি অনেকটাই কমে যায়।
-
বেশি বেশি পানি পান করতে হবে
যদি আপনি প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তোলেন, তবে ধীরে ধীরে এসব সমস্যার উন্নতি হবে। পানি খেলে পেট ব্যথাও কম হয়। অনেকেই পর্যাপ্ত পানি পান করতে চান না বা ভুলে যান, কিন্তু পানি স্বল্পতার কারণে শরীরে বিভিন্ন অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
-
আদার চা পান করুন
আদা চা নিমিষেই পেট ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। তাই মাসিক চলাকালীন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ গরম আদা চা পান করা অভ্যাসে পরিণত করুন। এতে শুধু পেট ব্যথা কমবে না, বরং ক্লান্তি ও অস্বস্তিও অনেকটাই দূর হবে, আর আপনি দিনটি আরও স্বস্তিতে কাটাতে পারবেন।
-
মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে
পিরিয়ড চলাকালীন যতটা সম্ভব মানসিক চাপমুক্ত থাকা জরুরি। এ সময় নানা ধরনের স্ট্রেস ও দুশ্চিন্তা মাথায় ভিড় জমাতে পারে, যা ব্যথার অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দেয়। মানসিক চাপ শুধু পিরিয়ডের ব্যথাই নয়, শরীরে আরও নানা ধরনের অসুস্থতার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই শরীর ও মন দুটোই সুস্থ রাখতে এই সময়ে নিজেকে যতটা সম্ভব চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
পিরিয়ডের পেটে ব্যথার জন্য কি কি খাবার এড়িয়ে চলবেন?
পিরিয়ডের সময় এমন কিছু খাবার আছে যেগুলো খেলে পেটে ব্যথা বাড়তে পারে, তাই এই ধরনের খাবার এড়ানো উচিত। অনেক নারীর ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময় চা বা কফি পান করলে পেটে ব্যথা তীব্রতর হয়, তাই যদি আপনারও এমন সমস্যা থাকে তাহলে এই সময় চা-কফি থেকে বিরত থাকাই ভালো। এছাড়া, পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত চিনি খাওয়া পেটের ব্যথা বাড়াতে পারে।
তাই মাসিক চলাকালীন সময় মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা উচিৎ। পাশাপাশি ফার্স্ট ফুড এবং লবণ খাওয়াও কম করতে হবে, অন্তত এই সময়ে। এই সময়ে এমনিতেই পেট ব্যথা হয়, এরপর যদি উল্টা পাল্টা খাবারের কারণে গ্যাস হয় তাহলে ব্যথা আরও তীব্র হতে পারে। তাই উক্ত খাবার গুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
FAQs
ওষুধ খেলে কি পিরিয়ডের ব্যথা কমে?
হ্যাঁ, ওষুধ খেলে পিরিয়ডের ব্যথা কমে। আইবুপ্রোফেন, অ্যাসপিরিন এবং প্যারাসিটামল এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। তবে পিরিয়ডের ব্যথা হলে বিশেষ করে কিশোরী বয়সে সরাসরি ঔষধ নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ অযথা ঔষধ সেবনের ফলে জরায়ুতে সংক্রমণ বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই প্রথমে প্রাকৃতিক এবং ঘরোয়া উপায়গুলো অবলম্বন করে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করা উচিত।
পিরিয়ডের ব্যথা হলে বাচ্চা হতে কোন সমস্যা হয়?
না, কারণ মাসিকের সময় পেতে ব্যথা হওয়াটা একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়। কারো ব্যথা কম হয় আবার কারো বেশি। ব্যথা যতক্ষণ মাত্রাতিরিক্ত না হয় বা এর সাথে আর কোন অস্বস্তিকর উপসর্গ দেখা না দেয় ততক্ষণ চিন্তার কিছু নেই। অতিরিক্ত ব্যথা অনেক কারণেই হতে পারে, তবে এজন্য ভবিষ্যতে বাচ্চা জন্মদানে কোন সমস্যা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
পিরিয়ডে কতটা ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক?
পিরিয়ডের সময় ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। সাধারণত পিরিয়ড শুরুর আগে বা শুরুর প্রথম ২/৩ দিনে পেটের নিচের অংশে টান বা হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত কয়েক ঘণ্টা থেকে ১/২ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এটিকে স্বাভাবিক ব্যথা হিসেবেই ধরা হয়। তবে ব্যথা যদি অতিরিক্ত থাকে এবং এর সাথে যুক্ত হয় আরও নানা উপসর্গ তাহলে অবশ্যই তা চিন্তার কারণ।