পিরিয়ড নারীর জীবনের এক স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা সন্তানধারণের ক্ষমতা প্রদান করে। এটি কোনো লজ্জা বা সংকোচের বিষয় নয়; বরং এ সময়ে নারীর প্রয়োজন বাড়তি যত্ন, সহানুভূতি এবং সবার সহযোগিতা। একজন মেয়ে যখন কিশোরী বয়সে পৌঁছায় তখন তাঁকে যত দ্রুত সম্ভব পিরিয়ড সম্পর্কে জানাতে এবং বোঝাতে হবে। পিরিয়ড নিয়ে কীভাবে কিশোরীদের শিক্ষা দেওয়া যায় সে সম্পর্কেই আমাদের আজকের লেখাটি।
এক সময় ছিল যখন পিরিয়ডকে ঘিরে নারীদের নিয়ে নানা কুসংস্কার ও ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল। অনেকেই বিষয়টিকে অশুচি ভাবতেন, যার ফলে বাধাগ্রস্ত হতো নারীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার অনেকটাই দূর হয়েছে, বদলে গেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা বিশ্বাস করি যে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই এই বিষয়ে যত জানবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ততটা সহজ হবে।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার কারণ কী?
পিরিয়ড নিয়ে কিশোরীদের কেন শিক্ষা দেওয়া দরকার?
পিরিয়ড কোনো লজ্জা বা গোপন করার মতো বিষয় নয়, এটি নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা চলাকালীনও স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। আগে পিরিয়ড নিয়ে নানা কুসংস্কার ও ট্যাবু প্রচলিত ছিল, যা মেয়েদের জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত। অনেকেই এ সময় স্কুলে যেত না, পরীক্ষাও মিস করত, কারণ বিষয়টি খোলাখুলি বলা যেত না।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মেয়েরা পিরিয়ড হলে দ্বিধাহীনভাবে শিক্ষকদের, এমনকি পুরুষ শিক্ষকের সঙ্গেও, প্রয়োজনীয় বিষয় শেয়ার করতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবে তাদের দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে পারে। কিশোরীদের কেন এই বিষয়ে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন তাঁর কয়েকটি কারণ নিচে ব্যাখ্যা করা হলোঃ
-
স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে
কিশোরীদের জানা দরকার এটি কীভাবে হয়, কেন হয় এবং এ সময় কীভাবে নিজের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে হয়। পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার, নিয়মিত পরিবর্তন, হাত ধোয়া এবং কাপড় পরিষ্কার ও শুকনো রাখা – এসব অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। সঠিক তথ্য জানলে তারা নিজেদের শারীরিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে আরও সচেতন হয়।
-
ভুল ধারণা দূর করতে
আমাদের সমাজে এখনো পিরিয়ড নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার ও ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সঠিক শিক্ষা পেলে তারা বুঝতে পারে যে পিরিয়ড একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যার সঙ্গে অপবিত্রতার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে তারা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং বন্ধু বান্ধবদের মাঝেও সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
-
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে
শরীরের পরিবর্তন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে কিশোরীরা স্কুল, খেলাধুলা, বা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাবোধ করে না এবং প্রয়োজনে মা, শিক্ষকের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে পারে। নিজের শরীরের এমন একটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়া তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় যা তাঁদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে।
-
জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক রাখতে
অনেক মেয়ে পিরিয়ডের সময় স্কুলে যায় না বা দৈনন্দিন কাজ বন্ধ রাখে। এর পেছনে প্রধান কারণ ব্যথা, অস্বস্তি, বা সঠিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকা। সঠিক জ্ঞান ও প্রস্তুতি থাকলে তারা আগেভাগে প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে রাখতে পারে। এতে তারা পড়াশোনা বা খেলাধুলা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে।
-
পূর্ব মানসিক প্রস্তুতি
কৈশোরে প্রথম পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা অনেক সময় ভয় বা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সঠিক শিক্ষা থাকলে তারা বুঝতে পারে যে এটি কোনো রোগ নয়, বরং শরীরের স্বাভাবিক পরিবর্তনের অংশ। আগে থেকে জানা থাকার ফলে তাঁদের প্রথম পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা ভীতিকর হয়না। এর ফলে ভবিষ্যতেও পিরিয়ড নিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাসী রাখতে সাহায্য করে।
পিরিয়ড নিয়ে কীভাবে কিশোরীদের শিক্ষা দেওয়া যায়?

কিশোরীদের পিরিয়ড নিয়ে শিক্ষা দেওয়া খুবই জরুরি, কারণ এটি তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সহায়ক। তাঁদের পিরিয়ডকাল শুরু হওয়ার আগেই এ বিষয়ে শিক্ষা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। বিভিন্ন রকম উপায়ে তাঁদের শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। এমনই কয়েকটি উপায় নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
-
খোলামেলা আলোচনা করতে হবে
পিরিয়ডকে কিশোরীদের কাছে একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরুন। প্রথম পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগেই কথা বলা শুরু করুন। এতে তারা অপ্রস্তুত থাকবে না এবং হঠাৎ করে ভয় পেয়ে যাবে না। কোনো ধরনের অস্পষ্ট বা নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, যা তাদের মনে লজ্জা বা সংকোচ তৈরি করতে পারে।
-
স্বাস্থ্যবিধি শেখাতে হবে
পিরিয়ডের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, প্যাড বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ সঠিকভাবে ব্যবহার ও পরিবর্তনের সময়সীমা, হাত ধোয়ার অভ্যাস; এসব ব্যবহারিক বিষয় শেখানো দরকার। প্রয়োজনে তাঁদেরকে বাস্তবে দেখিয়ে দিন এ সময় যা যা করতে হবে।0
-
মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা
প্রথম পিরিয়ড অনেকের জন্য ভয়ের কারণ হতে পারে। তাঁদেরকে বোঝাতে হবে যে এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এক্ষেত্রে পিরিয়ড কিভাবে হয়, কতদিন থাকে, কি কি উপসর্গ দেখা দেয় ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁদেরকে বললে ভয় অনেকাংশে কমে আসবে।
-
পিরিয়ডের ভালো দিক সম্পর্কে জানান
একজন মেয়ের জন্য পিরিয়ড হওয়া খুবই ভালো একটি স্বাস্থ্যগত প্রক্রিয়া। নির্ধারিত সময়ে এটি শুরু হওয়া আরও ভালো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কিশোরীদের মধ্যে পিরিয়ডের প্রতি এক ধরনের অনীহা দেখা দেয়, যার থেকে শুরু হয় দ্বিধা এবং ভয়। তাঁদেরকে বোঝাতে হবে যে নারী দেহের জন্য পিরিয়ড হওয়া কতটা জরুরী এবং উপকারি।
-
পরিবার ও শিক্ষকের সম্পৃক্ততা
পরিবারের মা, বড় বোন এবং স্কুলের শিক্ষকরা কিশোরীদের এই বিষয়ে শিক্ষা দিতে পারেন। তাঁরা যাতে এই সময়ের সুবিধা অসুবিধা পরিবারের লোক এবং শিক্ষকের সাথে শেয়ার করতে পারে সেজন্য তাঁদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। পিরিয়ডের প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকেই আসা উচিৎ।
-
শিক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার করতে হবে
শুধু কথা বলে শেখানোর চেয়ে পিরিয়ডের ধাপগুলো একটি সহজ চিত্র দিয়ে দেখানো যেতে পারে। স্কুলে সচেতনতামূলক পোস্টার ঝুলিয়ে রাখা এবং মাঝে মাঝে বিভিন্ন ওয়ার্কশপের আয়োজন করা কিশোরীদের মনে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
FAQs
প্রথম পিরিয়ডের সময় কিশোরীরা কি ধরনের ভুল করে থাকে?
প্রথম পিরিয়ডের সম্য কিশোরীরা যেসব ভুল করে থাকে তা সাধারণত সঠিক ভাবে না জানার কারণেই করে থাকে। এ সময় তাঁরা পিরিয়ডের সময় শরীরের পরিবর্তন বা ব্যথাকে করে অসুস্থতা মনে করে। পিরিয়ড সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকায় অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ভুল করে, যেমন প্যাড বা কাপ বদলাতে অনীহা বা অজ্ঞানতাবশত শারীরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কম রাখা ইত্যাদি। এছাড়া অনেকেই প্রথম পিরিয়ডের সময় অধিক লজ্জা বা ভয় পায়, যার ফলে কাউকে জানানোর বা সাহায্য চাওয়ার সাহস হয় না।
পিরিয়ড নিয়ে বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা কেন জরুরি?
পিরিয়ড নিয়ে বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা খুবই জরুরি কারণ এতে মেয়েরা মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যখন তারা তাদের অনুভূতি, প্রশ্ন বা সমস্যা মুক্তভাবে শেয়ার করতে পারে, তখন লজ্জা বা ভয় কমে যায়। এছাড়া পরিবার ও বন্ধুরা পরামর্শ ও সমর্থন দিয়ে যেকোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
পিরিয়ড চলাকালীন কোন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি?
পিরিয়ডের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলা খুব জরুরি। প্রথমত, সব সময় পরিষ্কার স্যানিটারি প্যাড এবং সঠিক অন্তর্বাস ব্যবহার করা উচিত। একটি প্যাড চার ঘণ্টার বেশি পরিধান করা উচিত নয়। তাই প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর প্যাড পরিবর্তন করা দরকার। প্যাড বদলানোর আগে অবশ্যই যৌনাঙ্গকে পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নেয়া এবং শুকনো কাপড় দিয়ে আস্তে মুছে নেওয়া উচিত, যাতে কোনো সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে।