গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়। এই সময়ে শরীরে নানান ধরনের শারীরিক পরিবর্তন ঘটে, যা মা ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন অনেক মা ই আছেন যাদের গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হয়। তাই একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে কী করব?
রক্তপাতকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয় এবং সময়মতো সঠিক কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ মা ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চলুন আজ আমরা গর্ভকালীন সময়ে রক্তপাত হলে কি করণীয় বা কেনই বা হয় এই রক্তপাত সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
আরও পড়ুনঃ প্রেগন্যান্সির সময় ব্রেস্টে ব্যথা কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত অনেক সময় মায়েদের জন্য ভয় ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে প্রতিটি রক্তপাতই যে বিপদের সংকেত, তা নয়। নিচে গর্ভাবস্থায় রক্তপাতের সম্ভাব্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ তুলে ধরা হলোঃ
-
ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং
ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং গর্ভধারণের খুব শুরুর দিকে ঘটতে পারে কারণ ভূূণ জরায়ুর দেয়ালে লাগার সময় হালকা রক্তক্ষরণ হয়। এটি সাধারণত হালকা দাগছোপ আকারে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন স্থায়ী হয়।
-
থ্রেটেন্ড মিসক্যারিজ
প্রথম ত্রৈমাসিকে রক্তপাত ঘটলে এটি গর্ভপাতের সম্ভাব্য সতর্ক সংকেত হতে পারে। এতে মাঝারি মাত্রার রক্তপাতের সঙ্গে নাভির নীচে ক্র্যাম্প ধরনের ব্যথা দেখা যায়; কখনও রক্তের ক্লটও বের হতে পারে।
-
একটোপিক প্রেগন্যান্সি
একটোপিক গর্ভধারণে ভ্রূণ জরায়ুর বাইরে প্লেস হয়। এর ফলে সাধারণত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের আশেপাশে হালকা থেকে মাঝারি রক্তপাত ও উভয় পাশের পেটে ব্যথা দেখা দেয়।
-
মোলার গর্ভধারণ
মোলার প্রেগন্যান্সি একটি বিরল অস্বাভাবিক অবস্থা যেখানে প্লাসেন্টাল টিস্যুর অনিয়মিত বিকাশ ঘটে এবং ভ্রূণ অনুপস্থিত বা বিকৃত থাকে। এতে সাধারণত প্রথম ত্রৈমাসিকে অনিয়মিত রক্তপাত, গর্ভের আকার বেশি হওয়া, অস্বাধারণ উচ্চ hCG ইত্যাদি দেখা যায়।
-
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া
এক্ষেত্রে সাধারণত ব্যথাহীন, হঠাৎ হঠাৎ উজ্জ্বল লাল রক্তক্ষরণ হিসেবে দেখা দেয়; যৌনমিলন বা জরায়ুমুখে পরীক্ষার পরে রক্তপাত বাড়তে পারে। সন্দেহ হলে ট্রান্সভাজাইনাল আল্ট্রাসাউন্ডে প্লাসেন্টার অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে কখনও আগেভাগে সিজারিয়ান সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।
-
প্লাসেন্টাল অ্যাব্রাপশন
এটি জরায়ুর দেয়াল থেকে প্লাসেন্টা আগেভাগে আলাদা হয়ে গেলে হয়। এতে প্রায়ই তীব্র পেটে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, জরায়ু সচরাচর স্পর্শকাতর হয়; রক্তপাত থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় ডাক্তার দেখানো জরুরি।
-
অকাল প্রসব
যদি ৩৭ সপ্তাহের আগে জরায়ু সংকুচিত হতে শুরু করে এবং জরায়ুমুখ খুলতে শুরু করে, তাহলে এটি অকাল প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। এর ফলে ঋতুস্রাবের ব্যথার মতো অনুভূত হতে পারে অথবা শুধু তলপেটে বা পিঠের নিচের দিকে ঘন ঘন টান বা চাপ তৈরি করতে পারে।
-
ইউটেরাইন রাপচার
ইউটেরাইন রাপচার বা জরায়ু ফেটে যাওয়া গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন সময়ের একটি অত্যন্ত বিরল কিন্তু মারাত্মক জটিলতা। সাধারণত এটি প্রসব বেদনার সময় ঘটে, বিশেষ করে যেসব নারীর আগে সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ পূর্বের সিজারিয়ানের সেলাইয়ের জায়গা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে থাকে।
গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক রক্তপাত এর লক্ষণ গুলো কী কী?

গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক রক্তপাতের কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকে, যা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এসব লক্ষণ সময়মতো চিহ্নিত করতে পারলে মা ও শিশুর জন্য জটিলতা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভবঃ
- স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি রক্তপাত হওয়া
- পেটের তীব্র ব্যথা এবং অসস্তি
- রক্তের সঙ্গে টিস্যু বা জমাট অংশ বের হওয়া
- মাথা ঘোরা বা অতিরিক্ত দুর্বলতা
- রক্তপাতের রঙে পরিবর্তন
- গর্ভের নড়াচড়ায় পরিবর্তন বা স্বাভাবিক না থাকা।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে?
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হওয়ার আগে এমন অনেক কিছুই করা যেতে পারে যা আপনার রক্তপাত হওয়াকে বাঁধা দিতে পারে। তাই রক্তপাতের পর ব্যবস্থা নেওয়ার থেকে রক্তপাত হতে না দেওয়াটাই ভালো। দেখে নিন এটি প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেঃ
- এই সময় শরীরে বাড়তি চাপ পড়ে, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশ্রাম শরীরকে পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে এবং জরায়ুর ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ কমায়।
- ভারী কিছু তোলা বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে জরায়ুতে চাপ পড়ে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই দৈনন্দিন কাজের পরিমাণ সীমিত রাখা উচিত।
- মানসিক চাপ হরমোনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে, যা গর্ভাবস্থায় রক্তপাত বা অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ইতিবাচক মানসিক অবস্থা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- পেটের নিচের অংশে আঘাত লাগলে জরায়ুর ক্ষতি হতে পারে এবং রক্তপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
- দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তি ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করে, যা গর্ভাবস্থায় বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে দুর্গম বা অপ্রস্তুত এলাকায় ভ্রমণ এড়িয়ে চলা উচিত।
- গর্ভাবস্থার কিছু সময় বিশেষ করে প্রথম ও শেষ দিকে যৌন সম্পর্ক জরায়ুর সংকোচন ঘটিয়ে রক্তপাতের কারণ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সহবাস এড়িয়ে চলা ভালো।
- থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ইনফেকশন ইত্যাদি থাকলে গর্ভাবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিলে রক্তপাতসহ অনেক ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে যেকোনো সমস্যা আগেভাগেই শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায়। চিকিৎসকের দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করাই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।
FAQs
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত মানে কি সবসময় গর্ভপাত?
না, গর্ভাবস্থায় রক্তপাত মানেই সবসময় গর্ভপাত নয়। অনেক সময় গর্ভাবস্থার শুরুতে হালকা রক্তপাত একেবারেই স্বাভাবিক হতে পারে। তবে, কিছু পরিস্থিতিতে রক্তপাত গর্ভপাতের প্রাথমিক লক্ষণও হতে পারে, বিশেষ করে যদি রক্তপাতের পরিমাণ বেশি হয়। এছাড়াও একটোপিক প্রেগন্যান্সি, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা প্লাসেন্টাল অ্যাব্রাপশনের মতো জটিল কারণেও রক্তপাত হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কখন রক্তপাত হলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে রক্তপাত হলে সেটি সাধারণত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়, কারণ এটি প্লাসেন্টা সংক্রান্ত জটিলতা। আবার যেসব মহিলার আগে সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জরায়ু ফেটে যাওয়ার মতো জটিলতাও ঘটতে পারে। তাই এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে কি আলট্রাসনোগ্রাম করানো উচিত?
হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে আলট্রাসনোগ্রাম করানো উচিত। এর মাধ্যমে রক্তপাতের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়, যার ফলে সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ সহজ হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা রক্তপাত হলে এটি ভ্রূণের অবস্থান ও হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক আছে কিনা তা জানার জন্য করা হয়।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে ভবিষ্যৎ গর্ভধারণে এর প্রভাব পড়ে কি?
গর্ভাবস্থায় রক্তপাতের ভবিষ্যৎ গর্ভধারণে প্রভাব নির্ভর করে রক্তপাতের কারণ ও জটিলতার ওপর। কিছু জটিল অবস্থায যেমন – ইউটেরাইন রাপচার, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা প্লাসেন্টাল অ্যাব্রাপশন এর মত সমস্যা হলে ভবিষ্যৎ গর্ভধারণে ঝুঁকি বাড়তে পারে। অন্যথায় চিন্তার কিছু নেই।