ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। সাধারণত বর্ষাকাল ও বর্ষার পর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়, কারণ এই সময় জমে থাকা পানিতে মশার বংশবৃদ্ধি হয়। এই রোগের জন্য এখনো কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং উপসর্গ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা গ্রহণই ডেঙ্গু মোকাবিলার প্রধান উপায়।
এই সময়ে উপযুক্ত ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া রোগীর দ্রুত সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় কোন খাবার গ্রহণ করা উচিত এবং কোনগুলো এড়িয়ে চলা দরকার, সে সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। আজ আমরা ডেঙ্গু রোগীর খাবার তালিকা সম্পর্কে আপনাদেরকে বলবো।
আরও পড়ুনঃ চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ সেরা ১০ ডাক্তারের তালিকা
ডেঙ্গু রোগীর খাবার তালিকাঃ
ডেঙ্গু রোগীর খাবারের তালিকা অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়া উচিত। আপনি দৈনিক যেসব খাবারে অভ্যস্ত ছিলেন সেগুলো এই সময়ের জন্য উপযোগী নাও হতে পারে। তাই কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত তখন তাঁর জন্য একটি আলাদা খাবারের তালিকা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এখানে এমন কিছু খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকবে যা রোগীর রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়ক হবে। খাবার গুলো নিম্নরূপঃ
-
পেঁপে ও পেঁপের পাতা
পেঁপেপাতার রস ডেঙ্গু রোগীর রক্তে কমে যাওয়া প্লাটিলেট দ্রুত বাড়াতে সহায়ক। একইভাবে পাকা পেঁপের জুসও প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এজন্য প্রতিদিন তাজা পেঁপেপাতা বেটে তার রস এক চামচ করে সকালে ও বিকেলে খাওয়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি রোগীকে পাকা পেঁপের জুস খাওয়ানোও উপকারী।
-
শাক-সবজি
গাজর, শসা, টমেটোসহ পানিযুক্ত সবজিগুলো ডেঙ্গু রোগীর জন্য উপকারী, কারণ এগুলো দেহে পানির ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে। ব্রোকলি বিশেষভাবে উপকারী, কারণ এতে প্রচুর ভিটামিন কে থাকে যা রক্তপাতের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
-
লেবুর রস
লেবুর রসে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে, যা প্লাটিলেট বাড়ানোর পাশাপাশি রক্তে প্লাটিলেট নষ্ট হওয়া রোধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এজন্য ডেঙ্গু রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে লেবুর শরবত খাওয়ানো অত্যন্ত উপকারী।
-
আমলকী
আমলকীতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। নিয়মিত আমলকী খেলে প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া রোধ হয় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
-
মিষ্টি কুমড়া ও কুমড়ার বীজ
মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে ভিটামিন এ, যা প্লাটিলেট উৎপাদনে সহায়তা করে। কুমড়ার বীজেও প্লাটিলেট বৃদ্ধিকারী উপাদান রয়েছে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর খাদ্যতালিকায় নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া ও এর বীজ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
-
অ্যালোভেরার রস
অ্যালোভেরা রক্ত পরিশোধনে সাহায্য করে এবং জীবাণুর সংক্রমণ রোধে কার্যকর। নিয়মিত অ্যালোভেরার জুস পান করালে রক্তে প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে সহায়তা পাওয়া যায়।
-
ডালিম
ডালিমে রয়েছে প্রচুর আয়রন, যা প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া এতে থাকা ভিটামিন শরীরের দুর্বলতা দূর করে। ডেঙ্গু রোগীকে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ মিলিলিটার ডালিমের জুস খাওয়ানো যেতে পারে, যা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত চালিয়ে গেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
-
সবজির স্যুপ
প্রতিদিন রোগীকে বিভিন্ন ধরনের স্যুপ যেমন সবজির স্যুপ, টমেটোর স্যুপ, চিকেন স্যুপ বা কর্ন স্যুপ খাওয়ানো যেতে পারে। এগুলো শরীরে পানির ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায়। নরম ভাত বা জাউয়ের সাথে স্যুপ খাওয়ানোও যেতে পারে।
-
পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার
ডেঙ্গু রোগীর জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২.৫ থেকে ৩ লিটার পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি। রোগীর পানি পান করতে অনীহা থাকলে ঘরে তৈরি ফলের রস ও ডাবের পানি খাওয়ানো যেতে পারে।
ডেঙ্গু রোগী কী কী খাবার এড়িয়ে চলবেন?

ডেঙ্গু রোগীর দ্রুত সুস্থতার জন্য সঠিক খাবার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিছু খাবার এড়িয়ে চলাও খুব জরুরি। ভুল খাদ্যাভ্যাস রোগীর শারীরিক অবস্থাকে খারাপ করে দিতে পারে এবং প্লেটলেট হ্রাস বা দুর্বলতা আরও বাড়াতে পারে। তাই নিম্নলিখিত খাবারগুলো এড়িয়ে চলুনঃ
-
তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার
বলভরে ভাজা ও বেশি তৈলাশিত খাবার সহজে হজম হয় না। দুর্বল অবস্থায় এগুলি পেট নষ্ট, বমি বা বদহজম বাড়াতে পারে এবং লিভারের ওপর অতিরিক্ত বোঝা দেয়, ফলে রোগ নিরাময় ধীর হতে পারে।
-
অতিরিক্ত মশলা ও ঝালযুক্ত খাবার
ঝাল ও টক, মসলাযুক্ত খাবার পাকস্থলী জ্বালা বা অ্যাসিডিটি, ডায়রিয়া বা বমি বাড়াতে পারে। এগুলো শরীরের পানির অভাব আরও বাড়ায় এবং রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে।
-
সফট ড্রিংকস এবং অতিরিক্ত চিনি
কোল্ড ড্রিংক, প্যাকেটজাত মিষ্টি জুস বা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় শরীরকে দ্রুত শক্তি দেয় না বরং ডিহাইড্রেশন বা রক্তের শর্করার ওঠানামা লাগানোর ঝুঁকি বাড়ায়। ডেঙ্গু হলে পরিষ্কার পানি, ডাবের পানি বেশি উপকারী।
-
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
ক্যাফেইন অনেক সময় ডায়ুরেটিক প্রভাব দেখা দেয়। এটি প্রস্রাব বাড়ায় এবং শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়। ডিহাইড্রেশন ডেঙ্গু রোগে বিপজ্জনক হতে পারে, তাই ক্যাফেইন এড়ানো উত্তম।
-
ভারী লাল মাংস বা ভারি খাবার
গরু/খাসি/ভারি গ্রেভি খাবার হজমে সময় নেয় এবং লিভারের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিতে পারে। রোগী দুর্বল থাকার কারণে এসব খাবার শরীরকে আরোগ্যে সাহায্য কম দেয়।
-
প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার
চিপস, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, প্যাকেটজাত বিস্কুট ইত্যাদিতে লবণ, অস্বাস্থ্যকর চর্বি ও preservatives বেশি থাকে এবং পুষ্টিমান কম। তাই এগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
FAQs
মসলাযুক্ত খাবার ডেঙ্গু রোগীর জন্য ক্ষতিকর কেন?
মসলাযুক্ত খাবার ডেঙ্গু রোগীর জন্য ক্ষতিকর হওয়ার প্রধান কারণ হলো এই ধরনের খাবার হজমে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং রোগীর শারীরিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় শরীরের হজম প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়। অতিরিক্ত মসলা যকৃতে চাপ ফেলে এবং এসজিপিটি বাড়িয়ে দিতে পারে, যা লিভারের জন্য ক্ষতিকর।
কেন ডেঙ্গু রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খাওয়ানো প্রয়োজন?
ডেঙ্গু রোগীর শরীরে পানিশূন্যতা খুব সহজেই দেখা দেয়, কারণ উচ্চ জ্বর ও ঘাম, কখনও কখনও বমি বা পাতলা পায়খানার কারণে শরীর থেকে অনেকটা পানি বের হয়ে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খাওয়ালে এই পানিশূন্যতা পূরণ হয়। তরল খাবার রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে, ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায়। পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ রক্ত ঘন হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে, যা ডেঙ্গুর জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
ডেঙ্গু হলে কি ফল খেতে হয়?
হ্যাঁ, ডেঙ্গু হলে ফল খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ফল শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বিশেষ করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন লেবু, কমলা, মাল্টা, পেয়ারা, কিউই ও স্ট্রবেরি রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে ও রক্তে প্লাটিলেট নষ্ট হওয়া রোধ করে। তবে খুব টক ফলের জুস এড়িয়ে চলা উচিত।