জন্মনিয়ন্ত্রণের ইতিহাসে পিলের আবিষ্কারকে বলা হয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। এটি শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ প্রতিরোধেই নয়, বরং মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ, কিছু হরমোনজনিত সমস্যার সমাধানেও সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তবে, যেকোনো ওষুধের মতো পিল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা রয়েছে। তাই, পিল সেবনের আগে অবশ্যই এর ভালো ও খারাপ দিক সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তারপর খাওয়া উচিৎ।
নিয়মিত পিল এবং ইমারজেন্সি পিল – সাধারণত এই দুই ধরনের পিল নারীরা সেবন করে থাকেন। তাই এদের উভয়ের সুবিধা ও অসুবিধার ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে আপনাদের। আমাদের আজকের আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাদেরকে সেইসব বিষয় সম্পর্কে জানানো যেগুলো পিল সেবনের আগে প্রত্যেকের জানা উচিৎ।
আরও পড়ুনঃ ইমার্জেন্সি পিল কি নাবালকেরা খেতে পারে?
নিয়মিত পিল কি?
নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল হলো এক ধরনের হরমোনযুক্ত ওষুধ যা নারীরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সেবনের মাধ্যমে গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে। এটি জরুরি গর্ভনিরোধক পিল বা ইমারজেন্সি পিল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, কারণ এটি নিয়মিত ব্যবহারের জন্য তৈরি এবং এর কার্যকারিতা জরুরি পিলের চেয়ে অনেক বেশি। নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের কার্যকারিতা নির্ভর করে প্রতিদিন একই সময়ে তা সেবন করার ওপর। যদি পিল সেবনে ধারাবাহিকতা না থাকে, তবে শরীরে কাজ করেনা সেভাবে।
উপকারিতাঃ
আপনি যদি নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল সেবন করেন, তাহলে শরীরের বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। পিল ব্যবহারে ডিম্বাশয়ের সিস্ট, রক্তস্বল্পতা, বাতব্যথা, একটোপিক প্রেগন্যান্সি এবং যৌনাঙ্গে প্রদাহজনিত রোগের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এছাড়া মাসিক চলাকালীন অস্বস্তি, খিঁচুনি ও ব্যথা লাঘবেও পিল কার্যকর ভূমিকা রাখে। পিল সেবন বন্ধ করলে স্বাভাবিক নিয়মে গর্ভধারণ সম্ভব হয়। বর্তমানে যে গর্ভনিরোধক পিল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে।
আর যাদের আগে থেকেই ব্রণের সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ বিশেষ উপকারী হতে পারে। তবে দীর্ঘদিন পিল সেবনের সময় কিছু নারীর স্তনের আকার বা কোমরের মাপ বেড়ে যেতে পারে। তাই এই সময়ে নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্যগ্রহণ এবং জীবনযাপনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
অপকারিতাঃ
পিল যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণে কার্যকর, তেমনি এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। দীর্ঘ সময় নিয়মিত পিল সেবনে কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে, আর যাদের নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক সমস্যা আছে, তাদের জন্য পিল সেবন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে। বিশেষ করে অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলে বা চিকিৎসকের পরামর্শে নিষেধ থাকলে পিল খাওয়া উচিত নয়।
অতিরিক্ত পিল সেবনে মানসিক অবসাদ বা হতাশা দেখা দিতে পারে, পাশাপাশি মেজাজ পরিবর্তন, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা ও মাথা ঘোরা অনুভূত হতে পারে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পিল সেবনে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত পিল খেলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তাই পিল ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
পিল সেবনের ফলে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যদিও এর বেশিরভাগই সাময়িক এবং কিছু সময় পর স্বাভাবিকভাবে ঠিক হয়ে যায়। তবে যারা দীর্ঘ সময় একটানা পিল ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই টানা দীর্ঘদিন পিল সেবন না করাই নিরাপদ।
ইমারজেন্সি পিল কি?
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিশেষ প্রয়োজনে মূলত ইমার্জেন্সি পিল সেবন করা হয়। অসতর্কতা বা কোনো ধরনের প্রটেকশন ছাড়া অনিরাপদ যৌনসম্পর্কের পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমাতে অনেকেই এই পিল গ্রহণ করেন। এটি সেবনের জন্য সাধারণত চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন হয় না। সাধারণত মিলনের পর ৩ দিনের মধ্যে, আর কিছু ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যে এই ওষুধ খাওয়া যায়। যত দ্রুত এটি সেবন করা হয়, তত বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায়। তবে এসব পিলের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যা সেবনকারীর শরীরে বিভিন্ন অস্বস্তি বা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। চলুন এর উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
উপকারিতাঃ
ইমার্জেন্সি পিল সাধারণত তখনই ব্যবহৃত হয় যখন অপ্রত্যাশিত বা অনিরাপদ যৌনমিলন ঘটে, কিংবা কোনো দুর্ঘটনাজনিত পরিস্থিতিতে দ্রুত গর্ভধারণ থেকে বাঁচতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে বা নিয়মিতভাবে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহার করলে উপকারের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকে। তারপরও এর কিছু গুণগত সুবিধা রয়েছে, যেমন—
- এই পিল গর্ভপাত ঘটায় না, বরং ডিম্বস্ফোটনের সময় বিলম্ব ঘটিয়ে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমায়।
- অনেকেই ভাবেন পিল খেলে ওজন বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এর সঙ্গে ওজন বৃদ্ধির কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই।
- এটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করে।
- পরিবার পরিকল্পনায় সাহায্য করে।
- স্বল্পমাত্রায় ব্যবহারে সাধারণত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না।
- অতীত বা ভবিষ্যতে গর্ভধারণে কোনো প্রভাব ফেলে না।
অপকারিতাঃ
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ইমার্জেন্সি পিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক ধরনের হতে পারে, যেগুলো হলো—
- কখনো কখনো চর্ম এবং যৌনাঙ্গে সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
- পিল সেবনের পরে বমি বমি ভাব অনুভূত হতে পারে।
- মাথাব্যথার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- অবিবাহিত মেয়েদের মধ্যে সাদাস্রাবের বৃদ্ধি হতে পারে।
- পরবর্তী মাসিকের সময়সূচি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে।
- জরায়ু থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- মুখে মেছতা বা ছোপছোপ দাগ দেখা দিতে পারে, পাশাপাশি মুখে ছোট ছোট ব্রণ হতে পারে।
পিল খাওয়ার ফলে সাধারণত স্বল্পমেয়াদে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে একবারের বেশি পিল একই মাসিক চক্রে ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদে গর্ভধারণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, কোনো মাসিক চক্রতে একবারের বেশি ইমার্জেন্সি পিল সেবন এড়ানো উচিত।
ইমার্জেন্সি পিল ও নিয়মিত পিলের মধ্যে পার্থক্য কী?

ইমার্জেন্সি পিল ও নিয়মিত পিল এক জিনিস নয়। দুইটি ওষুধের ব্যবহার ও কার্যকারিতা ভিন্ন। তাই সুবিধা অসুবিধার পাশাপাশি এই দুই ধরনের পিলের মধ্যকার পার্থক্য জেনে নিনঃ
| ইমার্জেন্সি পিল | নিয়মিত পিল |
| অনিরাপদ মিলনের পর জরুরি অবস্থায় ব্যবহার করা হয় | প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় নিয়মিত খাওয়া হয় |
| অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ রোধ করার তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ | দীর্ঘমেয়াদী গর্ভনিরোধ করে |
| মাত্র একবার বা একাধিকবার এটি ব্যবহার করা যায় | নিয়মিত দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করা হয় |
| এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি এবং তীব্র হতে পারে | তুলনামূলক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় |
| চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা যায় | এটি ব্যবহার করতে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন |
FAQs
পিল ব্যবহারের সময় কি কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?
পিল ব্যবহারের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলা প্রয়োজন যাতে এর কার্যকারিতা বজায় থাকে এবং শরীরের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। পিল নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী খাওয়া উচিত, কারণ অনিয়মিত সেবনে গর্ভনিরোধের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এটি ব্যবহারের আগে এবং ব্যবহারের সময় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দীর্ঘ সময় ধরে একটানা পিল সেবন এড়িয়ে চলা উচিত এবং মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়া উচিত। এসব সতর্কতা মেনে চললে পিলের ব্যবহার অনেক বেশি নিরাপদ হয়।
কোন ক্ষেত্রে পিল সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ?
যাদের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য পিল খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় পিল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, কারণ এটি গর্ভের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া যাদের বয়স ৩৫ বছর বয়সের উপরে, তাদের জন্যও পিল সেবন ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে পিল সেবন একেবারেই নিষিদ্ধ।
নিয়মিত পিল খাওয়ার ফলে শরীরে কী কী ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়?
নিয়মিত পিল খাওয়ার ফলে শরীরে নানা ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়। মাসিকের সময় যেসব তীব্র ব্যথা, খিঁচুনি বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ দেখা দেয়, তা অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে পিল হরমোন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ত্বকের ব্রণ কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘমেয়াদে পিল সেবনে ডিম্বাশয়ের সিস্ট বা জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকিও হ্রাস পায়।