প্ৰতিটি নারীর জীবনেই মাসিক বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া, যা সাধারণত মধ্যবয়সে ঘটে থাকে। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় মেনোপজ বলা হয়। এটি কেবল একটি শারীরিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি নারীদেহে হরমোনজনিত একটি ধাপ পরিবর্তন, যা একজন নারীর প্রজনন সক্ষমতার সমাপ্তি নির্দেশ করে।
নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু উৎপাদন এবং ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামক হরমোনগুলোর নিঃসরণ যখন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, তখনই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে মেনোপজের লক্ষণ, কারণ, জটিলতা এবং চিকিৎসা সম্পর্কে অনেক কিছুরই জানার রয়েছে। আজ আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানবো এই লেখা থেকে।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর দোয়া
পিরিয়ড কত বছর বয়সে বন্ধ হয়?
মহিলাদের পিরিয়ড সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে বন্ধ হয়। গড় বয়স প্রায় ৫০ বছর হলেও এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিছু মহিলার পিরিয়ড ৪৫ বছরের আগে বন্ধ হতে পারে, যা প্রিম্যাচিউর মেনোপজ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ৫৫ বছরের পরে পিরিয়ড বন্ধ হলে তা অপেক্ষাকৃত দেরিতে শুরু হওয়া মেনোপজের উদাহরণ।
বেশিরভাগ মহিলার জীবনের প্রায় ৪০% সময় তারা মেনোপজোত্তর বছরগুলো কাটান। মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মহিলারা প্রায়ই শারীরিক এবং মানসিক অস্বস্তি অনুভব করেন। যেহেতু হরমোনের মাত্রা ও পরিবর্তনের ধরন ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়, তাই মেনোপজের সঠিক বয়সও নারী থেকে নারীতে ভিন্ন হতে পারে।
মেনোপজ এর লক্ষণ গুলো কী কী?
মেনোপজ এর বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো অনেকেই জানেন না। সাধারণত একটি বয়সের পর থেকে আস্তে আস্তে এগুলো দেখা দিতে থাকে। দেখে নিন কারণ গুলো কী কীঃ
-
মাসিকের সময়ের পরিবর্তন
মেনোপজের শুরুতে ডিম্বাশয়ের হরমোন উৎপাদন অনিয়মিত হয়ে যায়। এর ফলে মাসিকের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু মাসে মাসিক বেশি দিন চলতে পারে, আবার কিছু মাসে কম সময়ের জন্য। কখনো কখনো মাসিক হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই পরিবর্তনগুলি মেনোপজের প্রাথমিক ও সবচেয়ে সহজে লক্ষ্য করা যায় এমন লক্ষণ।
-
হঠাৎ গরম অনুভূত হওয়া
মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের হ্রাস হঠাৎ শরীরে তাপ অনুভূতির কারণ হয়। শরীর বিশেষ করে মাথা, ঘাড় ও বক্ষভাগে হঠাৎ গরম অনুভব করে। অনেক নারী রাতে ঘুমের সময় ঘাম আসে। হট ফ্ল্যাশ শরীরকে অস্বস্তিকর করতে পারে এবং ঘুমের মানকে প্রভাবিত করে।
-
ঘুমের সমস্যা
মেনোপজের সময় ঘুমের ব্যাঘাত দেখা দিতে পারে। রাতের ঘুম ভেঙে যায়, ঘুম ঘন ও আরামদায়ক হয় না। কিছু মহিলার ক্ষেত্রে অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
-
মানসিক পরিবর্তন
হরমোনের হ্রাস নারীর মনের উপর প্রভাব ফেলে। ফলে চিড়চিড়া ভাব, হতাশা, দুশ্চিন্তা এবং মনোযোগ কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিছু নারী হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন বা স্মৃতিশক্তি কিছুটা দুর্বল হয়।
-
প্রস্রাব সংক্রান্ত সমস্যা
মেনোপজে ইস্ট্রোজেনের কম মাত্রার কারণে যোনির ঝিল্লি শুষ্ক হয়ে যায়। এর ফলে যোনিতে জ্বালা বা অস্বস্তি হতে পারে। এছাড়া প্রস্রাব সংক্রান্ত সমস্যা যেমন প্রায়ই প্রস্রাব আসা বা প্রস্রাব ধরা কঠিন হওয়া দেখা দিতে পারে। এটি হরমোন পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব।
-
হাড় ও মেদ বৃদ্ধি
মেনোপজে হরমোন কমে যাওয়ায় হাড় দুর্বল হতে পারে এবং অস্টিওপরোসিস বা হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া শরীরে মেদ বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে কোমর ও পেটের অংশে।
-
হরমোনজনিত পরিবর্তন
হরমোনের পরিবর্তনের কারণে যৌন ইচ্ছা কমতে পারে। ত্বক শুষ্ক ও পাতলা হয়ে যেতে পারে, চুলের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে এবং আগের তুলনায় চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব শারীরিক পরিবর্তন যৌন জীবনে প্রভাব ফেলে।
মেনোপজের জটিলতা গুলো কী কী?

মেনোপজের আগে এবং পরে শরীরে নানা প্রকার শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কারো ক্ষেত্রে এগুলো বেশি হয় আবার কারো ক্ষেত্রে কম। তবে একেবারেই যে শারীরিক জটিলতা দেখা দিবে না এটা বলা যায় না।নিম্নলিখিত জটিলতা গুলো প্রায় সবার ক্ষেত্রেই দেখা দেয়ঃ
- কার্ডিওভাসকুলার সমস্যাঃ ইস্ট্রোজেন হরমোন হৃদপিণ্ড ও রক্তনালী রক্ষায় সহায়ক। মেনোপজের পর হরমোনের অভাবে রক্তচাপ বৃদ্ধি, কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের সম্ভাবনাও বাড়ে।
- ওজন বৃদ্ধি ও মেদ জমাঃ হরমোনের পরিবর্তনের ফলে শরীরে চর্বি বিতরণ পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে পেটের চারপাশে মেদ জমে। এতে ওজন বৃদ্ধি হয় এবং শরীরের মেটাবলিজমে প্রভাব পড়ে। ফলে ডায়াবেটিস ও হৃৎপিণ্ডের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
- মানসিক ও আবেগগত সমস্যাঃ মেনোপজের সময় হরমোন পরিবর্তনের কারণে চিড়চিড়া ভাব, হতাশা, দুশ্চিন্তা এবং আবেগপ্রবণতা দেখা দিতে পারে। কিছু মহিলার মধ্যে ঘুমের সমস্যা এবং মানসিক চাপের কারণে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয়।
- ত্বক, চুল ও নখের পরিবর্তনঃ হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ত্বক শুষ্ক, পাতলা ও নমনীয়তা হারায়। চুলের বৃদ্ধি কমে যায় এবং চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। নখও দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়।
- যৌন সমস্যাঃ মেনোপজের সময় যৌন ইচ্ছা কমতে পারে। যোনির শুষ্কতা ও অস্বস্তি যৌন জীবনকে প্রভাবিত করে। এছাড়া হরমোনের পরিবর্তনের কারণে যোনিতে সংবেদনশীলতা কমতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকিঃ হরমোনের অভাবে দীর্ঘমেয়াদে হাড়, হৃদয় ও ডিম্বাশয়ের স্বাস্থ্য প্রভাবিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে টাইপ ২ ডায়াবেটিস, মেটাবলিক সিনড্রোম এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
FAQs
মেনোপজ নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাসিক কত মাস ধরে বন্ধ থাকতে হবে?
মেনোপজ নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাসিক চক্র টানা ১২ মাস ধরে বন্ধ থাকতে হবে। অর্থাৎ, কোনো নারী যদি এক বছরের মধ্যে একবারও মাসিক না পান, তা হলে তাকে মেনোপজে প্রবেশ করেছে বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মাসিক ধীরে ধীরে অনিয়মিত হতে পারে, তবে ১২ মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধ থাকলে মেনোপজ নিশ্চিত হিসেবে ধরা হয়।
৫৫ বছরের পরে পিরিয়ড বন্ধ হওয়াকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়?
৫৫ বছরের পরে পিরিয়ড বন্ধ হওয়াকে সাধারণত দেরিতে শুরু হওয়া Late Menopause হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং কোনো রোগ বা অস্বাভাবিকতা নির্দেশ করে না।