বর্তমান সময়ে ইউরিন ইনফেকশন খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। এটি নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। বিশেষ করে যাদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি, তাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। অনেকে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ না হওয়ায় সংক্রমণ সত্ত্বেও তা সহজে অনুভব করতে পারেন না। এর ফলে রোগটি অভ্যন্তরীণভাবে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।
তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ এবং কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে এই রোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আজ আমরা জানবো ইউরিন ইনফেকশনের কারণ, লক্ষণ ও ঔষধের নাম সম্পর্কে। এটি একটি সাধারণ রোগ হলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা হওয়া উচিত।
আরও পড়ুনঃ পাইলস এর লক্ষণ, চিকিৎসা, ঔষধের নাম, চিকিৎসা খরচ
ইউরিন ইনফেকশনের কারণঃ
ইউরিনারি ইনফেকশন প্রধানত তখন ঘটে যখন জীবাণু মূত্রনালী বা মূত্রথলিতে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- প্রায় ৮০% থেকে ৯০% ইউরিন ইনফেকশনের ক্ষেত্রে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া দায়ী । সাধারণত এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের অন্ত্রে থাকে, কিন্তু যখন এটি মূত্রনালী দিয়ে প্রস্রাবে প্রবেশ করে, তখন সংক্রমণ সৃষ্টি হয়।
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি না খেলে প্রস্রাব কম হয়, ফলে ব্যাকটেরিয়া মূত্রথলিতে দীর্ঘ সময় থাকে এবং সংক্রমণ ঘটায়।
- নারীদের হরমোনের পরিবর্তন, যেমন গর্ভাবস্থা বা মেনোপজ, ইউটিআই-এর ঝুঁকি বাড়ায়।
- পোশাকের পরিষ্কার না রাখা, দীর্ঘ সময়ে ভেজা অন্তর্বাস বা শৌচাগারে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
- ডায়াবেটিসের কারণে মূত্রে শর্করা বেশি থাকে, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।
- শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে, জীবাণু সহজেই সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।
- দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখা মূত্রথলিতে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে।
- যৌন মিলনের সময় ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে প্রবেশ করতে পারে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণঃ
ইউরিন ইনফেকশনের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি এই রোগে আক্রান্ত। তাই নিম্নলিখিত লক্ষণ গুলো দেখলে অবহেলা করবেন নাঃ
প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া: ইউরিনারি ট্র্যাক্টে সংক্রমণ থাকলে প্রস্রাব করার সময় পেটে বা মূত্রনালীর নিচের অংশে জ্বালা বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি সংক্রমণ বা প্রদাহের কারণে হয়।
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া: সংক্রমণ থাকলে মূত্রথলি সঙ্কুচিত বা সংবেদনশীল হয়ে যায়, ফলে ব্যক্তি সাধারণের চেয়ে বেশি ঘন ঘন প্রস্রাব করতে চায়।
রাতে বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়া: রাতের সময় ঘুম ভেঙে বারবার প্রস্রাব করতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।
গন্ধযুক্ত বা ঘোলাটে প্রস্রাব হওয়া: ইউটিআই তে প্রায়শই প্রস্রাবের রঙ বা গন্ধ পরিবর্তিত হয়। প্রস্রাব ধূসর বা ঘোলাটে হতে পারে এবং কখনও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যায়, যা সংক্রমণের ইঙ্গিত।
প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখতে কষ্ট হওয়া: প্রস্রাবের আকস্মিক চাপ অনুভব হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ। এটি মূত্রথলির সংক্রমণ এর কারণে ঘটে।
তলপেটে ব্যথা হওয়া: মূত্রথলির সংক্রমণ হলে পেটের নিচের অংশে, বিশেষ করে তলপেটে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হয়।
প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া: কোনও সময় প্রস্রাবের সাথে হালকা বা চোখে পড়ার মতো রক্ত দেখা দিতে পারে।
কোমরের পেছনে ব্যথা হওয়া: কিডনির সংক্রমণ থাকলে কোমর বা পাঁজরের নিচের অংশে তীব্র ব্যথা হতে পারে, যা সাধারণত একপাশে অনুভূত হয়।
জ্বর আসা: যদি সংক্রমণ কিডনি পর্যন্ত পৌঁছায়, তবে জ্বর, শরীরে কাঁপুনি এবং ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া: কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণ হাইপোথার্মিয়ার মতো শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়াও ঘটাতে পারে।
ক্লান্তি ও বমি বমি লাগা: প্রদাহ এবং সংক্রমণ শরীরের শক্তি খায়, ফলে সারাদিন ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
ইউরিন ইনফেকশন কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
ইউরিনারি ইনফেকশন প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত, যাতে প্রস্রাব নিয়মিত হয় এবং মূত্রথলিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া ধুয়ে বের হয়। প্রস্রাব দীর্ঘ সময় আটকে রাখা এড়ানো উচিত, কারণ এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। শৌচাগারে হাইজিন মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। পোশাকের ক্ষেত্রে বেশি আঁটসাঁট বা ভেজা কাপড় পরা এড়ানো উচিত এবং সুতির অন্তর্বাস ব্যবহার করলে মূত্রনালী অঞ্চলে আর্দ্রতা কম থাকে, যা সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
যৌন মিলনের পর পরিষ্কার পানি দিয়ে প্রস্রাব করা ব্যাকটেরিয়া বের করতে সাহায্য করে। প্রয়োজন হলে কিছু ভেষজ বা হারবাল ঔষধও সহায়ক হতে পারে, তবে সেগুলো চিকিৎসকের পরামর্শে নেওয়া উচিত। এই সব নিয়ম মেনে চললে ইউরিনারি ইনফেকশন সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ইউরিন ইনফেকশনের ঘরোয়া প্রতিকার কী কী?
ইউরিনারি ইনফেকশন যদি তেমন গুরুতর না হয়, তবে সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে দ্রুত আরাম পাওয়ার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া যত্ন গ্রহণ করা উচিত। ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল গ্রহণ করা যেতে পারে। শিশুদের জন্যও প্যারাসিটামল সিরাপ ব্যবহার করা যায়, তবে শিশুকে সঠিক মাত্রায় দেওয়ার নিয়ম অবশ্যই জানা জরুরি।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং প্রচুর পানি পান করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি এমন পরিমাণে পান করা উচিত যাতে নিয়মিত স্বচ্ছ বা হালকা হলুদ রঙের প্রস্রাব হয়, যা শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া বের করতে সাহায্য করে। শসা নিয়মিত খাওয়া উপকারী, কারণ এতে প্রচুর পানি থাকে। প্রতিদিন অন্তত একটি শসার স্লাইস খাওয়া ইউটিআই প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া এক গ্লাস পানিতে এক চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে সপ্তাহে একবার সকালে পান করলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমানো যায়।
এছাড়া, পেটে, পিঠে এবং দুই উরুর মধ্যে গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে, যা অস্বস্তি ও ব্যথা উপশমে সহায়ক। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যৌন সহবাস থেকে বিরত থাকা উচিত। যদিও ইউরিনারি ইনফেকশন সাধারণত সংক্রামক নয়, সংক্রমণের সময় যৌন মিলন অস্বস্তিকর হতে পারে এবং রোগ নিরাময়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এই সহজ ঘরোয়া যত্নগুলো মেনে চললে দ্রুত আরাম পাওয়া সম্ভব।
ইউরিনারি ইনফেকশন এর চিকিৎসা করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ইউরিনারি ইনফেকশন সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি বিভিন্ন জটিলতার কারণ হতে পারে। যদি সংক্রমণ কিডনিতে পৌঁছায়, তবে কিডনির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া, সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে পড়লে ‘সেপসিস’ নামক প্রাণঘাতী জটিলতা দেখা দিতে পারে, যা রোগীর জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে বারবার সংক্রমণ হলে মূত্রনালী সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে, যা মূত্রনালি ও মূত্রথলির সমস্যার পাশাপাশি যৌন ও প্রজনন ক্ষমতায়ও প্রভাব ফেলে। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে কিডনিতে সংক্রমণ ছাড়াও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে, যা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
ইউরিন ইনফেকশনের ঔষধের নামঃ
ইউরিন ইনফেকশনের জন্য বেশ কিছু ঔষধ রয়েছে যা বিভিন্ন মাত্রায় সেবন করতে হয়। ইনফেকশনের একেক অবস্থার জন্য আলাদা আলাদা ঔষধ প্রযোজ্য। তাই চিকিৎসক আগে রোগের অবস্থা যাচাই করে তারপর ঔষধ লিখবেন। ইউরিন ইনফেকশনের জন্য যেসব ঔষধ ডাক্তাররা সেবনের পরামর্শ দেন সেগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলোঃ
- নাইট্রোফুরানটোইন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার ইউরিন ইনফেকশনে সাধারণত ব্যবহৃত হয়। এটি দিনে ২ থেকে ৪ বার খাবারের সঙ্গে খেতে হয় এবং পুরো কোর্স ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত চলতে পারে।
- ফসফোমাইসিন একবারে একটি ডোজ হিসেবেই খাওয়া হয় এবং সাধারণত একদিনেই কোর্স সম্পন্ন হয়।
- ট্রাইমেথোপ্রিম/সালফামেথোক্সাজোলও একটি জনপ্রিয় ঔষধ, যা দিনে দুইবার খেতে হয় এবং কোর্সের সময়কাল ৩ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে।
- সেফালেক্সিন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ একটি অ্যান্টিবায়োটিক, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য। এটি দিনে ২ থেকে ৪ বার খেতে হয় এবং সাধারণত ৭ দিনের কোর্সে দেওয়া হয়।
- অধিক জটিল সংক্রমণের ক্ষেত্রে সেফট্রিয়াক্সোন ব্যবহার করা হয়, যা ইনজেকশনের মাধ্যমে দিনে একবার প্রয়োগ করা হয় এবং এর কোর্স ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত চলতে পারে।
- গুরুতর বা দীর্ঘস্থায়ী ইনফেকশনের জন্য সিপ্রোফ্লক্সাসিন ব্যবহার করা হয়, যা দিনে দুইবার খেতে হয় এবং প্রয়োজনে ৭ দিন বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে পারে।
FAQs
কেন পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হন?
নারীদের মূত্রনালী পুরুষদের তুলনায় অনেক ছোট এবং সরল, যার কারণে ব্যাকটেরিয়া সহজেই মূত্রথলি পর্যন্ত পৌঁছে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, যোনি এবং মূত্রনালীর সংযোগের কাছাকাছি অবস্থানও ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া যৌন ক্রিয়াকলাপের সময় ব্যাকটেরিয়া সহজে মূত্রনালীর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, যা নারীদের মধ্যে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ায়।
কোন ব্যক্তিদের ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেশি থাকে?
কিছু ব্যক্তির ইউরিনারি ইনফেকশনের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। বিশেষ করে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। এছাড়াও, ডায়াবেটিস রোগী এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের মধ্যে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বারবার যৌন মিলনের অভ্যাস থাকা ব্যক্তিদের মধ্যেও ব্যাকটেরিয়ার মূত্রনালীতে প্রবেশের কারণে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
প্রস্রাবের সময় জ্বালা বা ব্যথা হলেই কি সেটা ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ?
না, এটি সব সময় সংক্রমণের কারণে হয় এমন নয়। কখনও কখনও ডিহাইড্রেশন, প্রস্রাব সংক্রান্ত অল্প সমস্যা বা কিছু নির্দিষ্ট খাবারের কারণেও প্রস্রাবের সময় অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। তাই আগে কারণ নির্ণয় করা জরুরি।
ইউরিন ইনফেকশনের ঔষধ সেবনের কত দিনের মধ্যে এটি কাজ করে?
ইউরিন ইনফেকশনের ঔষধ সেবনের পর সাধারণত ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই উপসর্গগুলোর উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যায়। তবে সংক্রমণ সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য ঔষধের সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা অত্যন্ত জরুরি, এমনকি উপসর্গ কমে গেলেও মাঝপথে বন্ধ করা উচিত নয়।
ইউরিন ইনফেকশন হলে কি ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা সম্ভব?
ইউরিন ইনফেকশন হলে প্রাথমিক ও হালকা পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক সময় ঘরোয়া উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তবে পুরোপুরি নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনে ডাক্তারি চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন কারণ এটি যদি অবহেলা করা হয়, তা কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। শুধু ঘরোয়া উপায়ে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব নয়।